–ইস্! অ্যাসট্রে রয়েছে তবু কাপে ছাই ফেলছ! কী যে বদ অভ্যেস! বলে তাড়াতাড়ি কাপটা সরিয়ে নিল।
–সরি।
-হ্যাঁ, পুজো করছি, ফুলের মালা পরাচ্ছি সবই লিখেছি। বন্ধুর কাছে কিছুই লুকনো উচিত নয়।
–তা বেশ করেছ। কিন্তু ছবিটা নিয়েও তুমি একটু বাড়াবাড়ি শুরু করেছ। কি এমন আছে ছবির মধ্যে?
–তা দেখার চোখ তোমার নেই। থাকলে একথা বলতে পারতে না।
–ছবিটা নিয়ে এসো তো। ভালো করে দেখি. একবার।
–কি হবে দেখে?
–নিয়েই এসো না।
রীণা চেয়ারে দুপা তুলে হাঁটুর মধ্যে মুখ লুকলো।
–তুমি নিয়ে এসো।
–আমি ছুঁলে ছবিটা অশুদ্ধ হবে না তো? বলে সঞ্জয় হাসতে হাসতে উঠে গেল। রীণা কোনো উত্তর দিল না। হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে বসে রইল।
বাইরের ঘর থেকে সঞ্জয় জিজ্ঞেস করল, ছবিটা কোথায়?
রীণা উত্তর দিল না।
–এই শুনছ? ছবিটা তো তুমি তাকের ওপর রেখেছিলে। দেখছি না তো।
–তাহলে নেই।
–নেই মানে? অন্য কোথাও রেখেছ?
–জানি না।
সঞ্জয় যেন হোঁচট খেল–জানি না মানে?
রীণা এবার চেয়ার থেকে নেমে ধীরে ধীরে বাইরের ঘরে গেল–বলো কী বলছ?
–ছবিটা কোথায় গেল?
রীণা উত্তর না দিয়ে স্থিরদৃষ্টিতে সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, ওটা আর পাওয়া যাবে না। হারিয়ে গেছে।
সঞ্জয় অবাক হয়ে বলল, হারিয়ে গেছে মানে?
রীণা ধীর স্থিরভাবে বলল, হারিয়ে গেছে মানে হারিয়েই গেছে।
–অসম্ভব। আগের দিন ছবিটা তাকের ওপর রাখলে, এরই মধ্যে হারিয়ে গেল? আর হারাবেই বা কোথায়?
রীণা গম্ভীর গলায় বলল, তাহলে চুরি গেছে।
–চুরি! কে চুরি করল? বাড়িতে কে-ই বা আসে? কেনই-বা চুরি করবে? রীণা হালকা মেজাজে টেবিল থেকে ট্রানজিস্টারটা তুলে নিয়ে কাটা ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, গেলাসটা সেদিন কে ভাঙল? কি করে ভাঙল?
সঞ্জয় যেন অন্ধকারে চলতে চলতে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে থমকে গেল।
মিনিট কয়েক দুজনেই চুপচাপ। তারপর রীণা ট্রানজিস্টারটা রেখে দিয়ে যেন আপন মনেই বলল, শুধু একটা গেলাস ভাঙা বা ছবি চুরি যাওয়া নয়। আরো কিছু যাবে। তার মধ্যে আমার প্রাণ একটি। অবশ্য তাতে তোমার কিছু এসে যাবে না। পুপুটারই কষ্ট হবে।
বাজে কথা ছাড়ো তো। ছবিটা কি সত্যিই কেউ নিল?
-আমায় জিজ্ঞেস করছ? রীণা এবার পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে সঞ্জয়ের দিকে তাকাল।
–হ্যাঁ হ্যাঁ তোমাকে। তুমি ছাড়া এখানে আর কে আছে?
–তাহলে আমি বলছি–হ্যাঁ, ছবিটা সত্যিই কেউ নিল। যে নিতে এসেছিল সে নিয়ে গেল।
–কিন্তু কেন নিয়ে গেল?
রীণার ঠোঁটের কোণে একটু হাসি। –কে নিয়ে গেল ভাবছ না?
সঞ্জয় কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, না হয় ধরেই নিলাম ভূতে নিয়েছে। কিন্তু কেন? এত জিনিস থাকতে শিবানন্দর ছবিটার ওপরই তেনার দৃষ্টি পড়ল!
রীণা বলল, তুমি বোধহয় ভুলে যাওনি আমি বলেছিলাম–আগের দিনও সে টেবিলের কাছে ঘুরছিল। অসাবধানেই হোক বা ভয় দেখাবার জন্যেই হোক সেদিন গেলাসটা ভেঙেছিল।
এই পর্যন্ত বলে রীণা একটু থামল। সঞ্জয়ও চুপ করে রইল।
–তুমি কি বলতে চাইছ সেদিনও ছবিটা নেবার জন্যেই এসেছিল।
–হ্যাঁ।
–নিল না কেন?
–বোধহয় ওটা টেবিলে বা টেবিলের কাছে ছিল না।
–হ্যাঁ, ওটা ভুল করে ব্যাগেই থেকে গিয়েছিল।
সঞ্জয় আবার কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বিরক্ত হয়ে বলল, বেশ। না হয় প্রেতাত্মাটি ছবিটার জন্যেই এসেছিল। কিন্তু কেন? নিশ্চয় বৃদ্ধের প্রেমে পড়েনি?
রীণা কষ্টে একটু হাসল। বলল, এখনো রসিকতা করতে পারছ! ভাবতে পারছ না, কী সর্বনাশ এগিয়ে আসছে।
সঞ্জয় হাসল না। বলল–আমি যা জানতে চাইলাম ওটা তার উত্তর হল।
রীণা বলল, ঠিক উত্তর আমিই বা কি করে জানব?
–আচ্ছা, ছবিটার পেছনে কি যেন লেখা ছিল? সঞ্জয় জিজ্ঞেস করল।
–পরম স্নেহাস্পদ শ্রীমান কপিলেশ্বর চৌধুরীকে স্নেহোপহার।
–আরও যেন কিছু লেখা ছিল মনে হচ্ছে।
–হ্যাঁ, শিবানন্দর স্বাক্ষর।
—-আর কিছু ছিল না?
—-ছিল। শিবানন্দ ভট্টাচার্যর ঠিকানা।
সঞ্জয় হঠাৎ বলে উঠল তাহলে কি ঠিকানার জন্যেই? কিন্তু ঠিকানা নিয়ে ও কি করবে? শিবানন্দর সঙ্গে দেখা করবে! বলে একটু হাসবার চেষ্টা করল।
রীণা শান্ত গলায় বলল–অন্যরকমও হতে পারে। তুমি যেন দেখা করতে না পার।
সঞ্জয় বিছানায় একটা ঘুষি মেরে বলল–দেখা করি এটাই বা চায় না কেন? তোমার ঐ প্রেতাত্মাটির সঙ্গে শিবানন্দর সম্পর্ক কী?
রীণ কোনো কথা বলল না। একটা রহস্যময়ী ছায়ার মতো ধীরে ধীরে নিঃশব্দে ভেতরের ঘরে চলে গেল।
.
০৭.
ঝড় হাওড়ার পঞ্চাননতলা-কদমতলার মধ্যে ক্ষীরোদতলা। মনেই হয় না এটা কলকাতার লাগোয়া জায়গা। জীবন এখানে ধীরে-সুস্থে, জিরিয়ে, ঢিমেতালে চলেছে। বাসিন্দারা সকলেই প্রায় সকলের পরিচিত।
এই ক্ষীরোদতলাতেই একতলা একটা বাড়ি। দরজায়, জানলায় চমৎকার রঙীন পর্দা, গেটের ওপরে মাধবীলতার বাহার। একনজর দেখলেই বোঝা যায় অন্য আর সব বাড়ির মধ্যে এ বাড়িটি একটা উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। আর এটা সম্ভব হয়েছে রুচি আর যত্নের গুণে। বাড়ির গৃহিণী স্বয়ং অক্লান্ত পরিশ্রমে বাড়িটিকে সুন্দর করে রেখেছেন।
বেলা তখন প্রায় সাড়ে চারটে। কাজের লোকের সঙ্গে সে-বাড়ির ছোট্ট মেয়েটি ইস্কুল থেকে গুটিগুটি ফিরল। বইয়ের ব্যাগটা বিছানায় ফেলে দিয়ে বললে, মা, আজ সন্ধের পর ভয়ানক ঝড় হবে।