কথা না বললেও রীণার মুখে কিন্তু এক টুকরো হাসি লেগেই ছিল। গল্প করছিল না, কিন্তু পুপুকে আদর করার মাত্রাটা একটু অস্বাভাবিক হচ্ছিল। আদরের সঙ্গে হাসি। শিশুর সঙ্গে এই রকম হাসির অর্থ কী? এই হাসির অন্য মানে আছে। এ একরকম উপেক্ষা।
রীণার এই উপেক্ষা-নীতির সঙ্গেও সঞ্জয়ের পরিচয় ছিল।
মান্তু রীণার বন্ধু। নবদ্বীপে একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়ত। সঞ্জয়ের মামা থাকত রীণাদের বাড়ির কাছাকাছি। সঞ্জয় মাঝেমাঝেই মামার বাড়ি নবদ্বীপে আসত। এই আসা-যাওয়ার সুযোগেই রীণা আর রীণার বান্ধবীটির সঙ্গে আলাপ, ঘনিষ্ঠতা।
বাড়িতে কথা বলার সুযোগ হতো না। তাই রীণাই একদিন সঞ্জয়কে মান্তুর বাড়ি যাবার জন্যে বলেছিল।
রীণা গিয়েছিল যথাসময়ের অনেক আগে। সঞ্জয়ের যেতে দেরি হয়েছিল। এই হলো তার অপরাধ! ব্যাস! শ্রীমতী রীণা হলেন ভীষণ ক্রুদ্ধ। রাগটা অবশ্য মুখে প্রকাশ করল না। করল বিচিত্রভাবে। চৌকিতে বসে দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে অনর্গল কথা বলে গেল মান্তুরই সঙ্গে। সামনে যে আর একজন বসে আছে যাকে নাকি বিশেষ করে ডেকে আনা হয়েছে–তাকে যেন চিনতেই পারল না।
রীণার আজকের আচরণটাও অনেকটা সেইরকম। সঞ্জয় যেন কেউ না।
-কী ব্যাপার? আজ যে আমার সঙ্গে বড়ো কথা বলছ না? রীণার মুখে ফুটে উঠল আবার বিচিত্র হাসি।–আমি রুগী, তুমি ডাক্তার। ডাক্তারের সামনে রুগীকে রুগীর মতোই থাকতে হয়। তাই না? কথাগুলো রীণা বলল যেন দাঁতে কেটে কেটে।
যা বাবাঃ! আজ হল কী?
–হাসপাতালে–মানে মেন্টাল হসপিটালে কোনো বেডটেডের ব্যবস্থা করতে পারলে নাকি?
রীণার কথায় যেন বিদ্যুৎ ঝলকে উঠল।
সঞ্জয় অবাক হয়ে বলল, কার জন্যে?
–সে কি! এরই মধ্যে ভুলে গেলে? তোমার স্ত্রীর জন্যে গো! যার মাথার ব্যামো হয়েছে, নার্ভ ফেল করে। বলেই পুপুকে রেখে রীণা হঠাৎ উঠে চলে গেল।
এক-একটা সময়ে এই-সব মান-অভিমান স্বামীদের ভালোই লাগে। কিন্তু তাই বলে সারাদিন পরিশ্রমের পর বাড়ি ফিরে এই মানসিক কসরৎ আর ভালো লাগে না।
সঞ্জয় একটু রাগ করেই পুপুকে কোলে তুলে নিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোল।
–কোথায় যাচ্ছ?
–পুপুকে নিয়ে একটু ঘুরে আসি।
–এই সন্ধেবেলায়?
–কি করব? রুগীর সামনে বসে থাকতে থাকতে সুস্থ মানুষও রুগী হয়ে যায়।
রীণা আবার একটু হাসল। সেই কেমন-কেমন হাসি। নিচে যাবে তো? কিন্তু মহিমাবাবুরা এখনও বসে আছেন।
–মাই গড! সঞ্জয় এক লাফে সিঁড়ি থেকে ঘরে এসে ঢুকল।
কফি খাবে?
–আবার কষ্ট করে করবে?
–আমিও খাবো। বলেই রীণা চলে গেল।
বেশ কিছুক্ষণ পর দু কাপ কফি নিয়ে এসে বসল। একটা কাপ যেন একটু অতিরিক্ত যত্নে সঞ্জয়ের দিকে এগিয়ে দিল। চোখাচোখি হল।
তখন থেকে তুমি অমন ঠোঁট টিপে টিপে হাসছ কেন বলো তো।
রীণা হেসেই বলল, বাঃ রে! রুগী বলে কি হাসতেও মানা নাকি?
–তা নয়। হাসিটা যেন কেমন-কেমন লাগছে।
রীণা চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে উদাস সুরে বলল, তা হবে। মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষণ।
কফিতে আরাম করে একটা চুমুক দিয়ে সঞ্জয় সিগারেট ধরাল।
না, ও হাসি আর যাই হোক মাথা খারাপের লক্ষণ নয়।
তবে? রীণা খুব হালকা করে কফিতে চুমুক দিল।
–মনে হয় তুমি কিছু বলতে চাইছ। এমন-কিছু যা শুনে আমি অপ্রস্তুতে পড়ি।
–ও মা! সে কী কথা! ইস্! কফিতে চিনি কম হয়েছে। আমার সত্যি মাথার ঠিক নেই। বলে রীণা হঠাৎই উঠে গেল। তারপর বেশ একটু দেরি করে সুগার-পটটা এনে টেবিলে রাখল। তা থেকে সামান্য একটু চিনি তুলে কফিতে মিশিয়ে নিয়ে বলল, তুমি ডাক্তারমানুষ! তোমায় আমি অপ্রস্তুতে ফেলতে পারি? না হয় আমি মানসিক রুগীই। তা বলে নিজের স্বামীকে অপ্রস্তুতে ফেলা। ছিঃ!
সঞ্জয়ের পক্ষে ধৈর্য ধরা অসম্ভব হয়ে উঠল। বলল, দোহাই তোমার। আর রহস্য কোরো না। ব্যাপারটা কি আমায় খুলে বলো।
ব্যাপার আবার কি? যথা পূর্বং তথা পরম্।
–সারা দুপুর কি করলে?
রীণা আবার একটু হাসল।–অ-নে-ক কাজ। তুমি চলে গেলে দরজায় ভালো করে খিল দিলাম। তারপর পুপুকে চান করালাম, খাওয়ালাম। নিজে চান করলাম, খেলাম। একটু ঘুমোলাম।
–ঘুম হল?
—হু-উ। বলে আদুরে মেয়ের মতো মাথা দোলাল। তারপর ঘুম থেকে উঠে ট্রানজিস্টারটা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করলাম।
–ভয়টয় পাওনি তো?
–ভয়? কি জানি। মনে নেই।
–ভেরি গুড! মনে না থাকাই ভালো।
–ততক্ষণে পুপু উঠে পড়েছে। ওকে নিয়ে ঘরে তালা দিয়ে দোতলায় গেলাম। বন্দনার মায়ের সঙ্গে একটু গল্পও করলাম। তারপর ওপরে এসে জলখাবার করতে বসলাম। জলখাবার হয়ে গেলে পুপুকে নিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। তারপর তুমি এলে। ব্যস্! আমার কথাটি ফুরল, নটে গাছটি মুড়ল। ও হ্যাঁ, এর মধ্যে মান্তুকে একটা চিঠিও লিখলাম।
–কি লিখলে?
–সে-সব আমাদের প্রাইভেট কথা। তোমায় বলব কেন? বলে কফির পেয়ালাটা সরিয়ে রাখল।
–অবশ্য তোমার কথাও ছিল। হাসপাতালের ডিউটির পর পেশেন্ট দেখতে গিয়েছিলে। মহিলা পেশেন্ট বোধহয়, নইলে রাত নটা পর্যন্ত থাকবে কেন? বুক, পেট, তলপেট ভালো করে দেখতে হয়েছিল তো।
-ইস! এইসব বাজে কথা লিখেছ?
–হু-উ। তারপর লিখেছি, কে একজন তোমাকে একটা বুড়োর ছবি দিয়েছিল। সেই ছবির কথাও লিখেছি। সাংঘাতিক চোখ, যেন ত্রিকালদর্শী তান্ত্রিক!
–সেই ছবিটা পুজো করছ লিখেছ নাকি?