আজ কিন্তু রীণা এতটুকু আত্মহারা হয়ে যায়নি। পুপুর এই যে কান্না এটা যে স্বাভাবিক নয় তা সে বুঝে নিয়েছে। যে এসেছে তার সঙ্গে এই কান্নার যোগ আছে। সে এও জানে বাইরে যে এসে দাঁড়িয়েছে বাইরে থেকেই সে চলে যাবে না। সে ভেতরে আসবেই।
রীণা তাই পুপুর কান্না শুরু হওয়ার পর থেকেই প্রতিটা মুহূর্ত অনুভব করতে পারছিল।
এবার রীণা দুরু দুরু বুকে ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকাল। অন্ধকার বাইরের ঘরে প্রথমেই যেটা নজরে পড়ল সেটা হচ্ছে দুটো জ্বলন্ত চোখ। অন্ধকারে ভাসছে।
রীণা চেঁচাল না–কিংবা চেঁচাতে পারল না। এক হাতে পুপুকে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে অন্য হাতে বিছানার চাদর শক্ত করে চেপে রইল।
রীণা দেখছে তো দেখছেই। সেই জ্বলন্ত চোখ দুটো থেকে নিজের চোখ সরিয়ে নেবার উপায় নেই।
একটু পরেই অন্ধকারের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম শরীর ভেসে উঠল। ক্রমে সেই শরীরের ওপর দেখা দিল কোট প্যান্ট। কালো পোশাকটা অন্ধকারে যেন মিশে ছিল। এতক্ষণে ফুটে উঠল। …।
এই অবস্থাতেও–আশ্চর্য রীণা তুলনা করছিল আগের রাতে দেখার সঙ্গে আজকের এই দেখা। সেদিন যেন সবই বড়ো তাড়াতাড়ি। সবই যেন অতর্কিতে। আর আজ? আজ যা ঘটছে সব ধীরে ধীরে সময় মেপে মেপে।
কিন্তু এ দেখাও কি চোখের ভুল?
না, সে স্বপ্ন দেখছে না। জেগে আছে। এই তো পুপু বুকের মধ্যে মুখ গুঁজেও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এই তো মশারি টাঙানো। মেঝেতে মশারির মধ্যে পুপুর বাবা শুয়ে। ঐ তো রাস্তায় শরীর শব্দ…কোনোটাই তো ভুল নয়। তাহলে?
হঠাৎই দেখল মূর্তিটা টেবিলের কাছে পাক খাচ্ছে। এক বার, দুবার, তিন বার। তারপরেই জ্বলন্ত চোখ দুটো শূন্যে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে আসতে লাগল। রণা আর চুপ করে থাকতে পারল না। চিৎকার করে উঠল–ওগো! শু-ন-ছ–
ধড়মড় করে উঠে বসল সঞ্জয়।
–আঁ, কি হয়েছে?
–আবার এসেছে-আবার এসেছে।
বলতে বলতে রীণা কেঁদে উঠল। পুপুও ঠিক তখনই ককিয়ে কাঁদতে লাগল।
মুহূর্তমাত্র।
সঞ্জয় টর্চ হাতে মশারি তুলে বাইরের ঘরে ছুটে গেল। সুইচ অন করার সময়ও পেল না।
অন্ধকারের মধ্যে ডাক্তারের হাতের পাঁচ ব্যাটারির টর্চের আলো ছিটকে পড়ল।
-না, কেউ কোথাও নেই।
এবার সঞ্জয় সব ঘরের সুইচ অন করে দিল। দুখানা ঘর আলোয় ভরে গেল। দেখা গেল দরজা যেমন ভেতর থেকে বন্ধ ছিল তেমনই বন্ধ রয়েছে।
কই? কোথায় কে? বিরক্তির সঙ্গে বিদ্রূপ ঝলকে উঠল সঞ্জয়ের গলায়। রোজ রোজ এইভাবে Scene create করবে? ঘুম নষ্ট তাছাড়া লোকেই বা কী বলবে? তোমার বোঝা উচিত
রীণা শুধু ক্লান্ত স্বরে বলল–ও এসেছিল গো–সত্যিই এসেছিল। তুমি বিশ্বাস করো। উঃ! বুকের মধ্যে এখনো কিরকম করছে।
বলতে বলতে রীণা হঠাৎ মেঝেতে শুয়ে পড়ল।
কী হল? রীণা-রীণা—
রীণার বুকের ভেতর থেকে একটা ঘড়ঘড়ে স্বর বেরিয়ে এল। তারপর সঞ্জয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কি যেন ইশারা করল।
সঞ্জয় তাড়াতাড়ি কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে নিয়ে এল। রীণা কোনোরকমে সঞ্জয়কে আঁকড়ে ধরে উঠে বসে গেলাস নিঃশেষ করে জল খেল। তারপর দেহ এলিয়ে খনখনে গলায় বলল, আমি মরে যাব। ও আমাকে মারবে। বেশ বুঝতে পারছিলাম লোকটা চোখে ইশারা করে আমাকে ডাকছিল। আমি জানি ওটা হচ্ছে মরণডাক। আমাকে বোধহয় মরতে হবে।
সঞ্জয় ধমক দিয়ে বলল, কী যা তা বকছ! এরকম করলে কালই তোমায় হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে আসব।
–তোমার যা ইচ্ছে তাই করো, যেখানে খুশি পাঠাও, আমি এখানে আর টিকতে পারব না।
–বেশ, তাই হবে। এখন বলো তো ঠিক কি দেখেছিলে।
সঞ্জয় একটা সিগারেট ধরাল।
রীণা সব ঘটনা বলে গেল।
ধৈর্য ধরে সঞ্জয় সব শুনে গেল। কথার মধ্যে নিজে একটি কথাও বলেনি।
রীণার কথা শেষ হলে বলল, টেবিলের কাছে ঘুরছিল?
-হ্যাঁ। টেবিল থেকে দেওয়াল। একবার মনে হল যেন দেওয়ালের মধ্যে মিশে গেল। তারপরেই দেখি আবার বেরিয়ে এসেছে। তারপরেই আমার দিকে চোখের ইশারা করতে করতে তাড়া করে এল।
শেষের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে সঞ্জয় শুধু জিজ্ঞেস করল, আগের দিনও টেবিলের কাছে ঘুরছিল না?
হ্যাঁ
আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। নিঃশব্দে পায়চারি করতে লাগল।
দুটো ঘরেই এমনকি বাথরুমেও আলো জ্বলছিল। ভাড়াটেদের ঘুম ভেঙে থাকলে হয় তো ছুটে আসবে। সঞ্জয় তাই তাড়াতাড়ি সব আলো নিভিয়ে দিল। অন্ধকারে শুধু জ্বলতে লাগল সঞ্জয়ের সিগারেটের আগুন।
মনে মনে বলল, নাঃ, একেবারে Psychopathic Patient হয়ে গেল! একই জনকে একজনেই প্রায় দেখছে। অথচ আমি দেখতে পাচ্ছি না। শেষ পর্যন্ত কি আমাকে অলৌকিক কিছুতে বিশ্বাস করতে হবে?
পরের দিন সকালে বেশ একটু বেলাতেই ঘুম ভাঙল সঞ্জয়ের। দেখল রীণা তখনো ঘুমোচ্ছ। জানলা দিয়ে রোদ এসে পড়েছে মশারির ওপর। এত বেলা পর্যন্ত রীণা কখনো ঘুমোয় না।
কিন্তু এই কি ঘুমন্ত চেহারা?
মেয়েদের স্বাভাবিক ঘুমের মধ্যেও একটা সুন্দর আকর্ষণী শক্তি থাকে। শোয়ার ভঙ্গিটি, শরীর জড়িয়ে শাড়ির বিন্যাস, শান্ত স্নিগ্ধ মুখের ওপর বন্ধ চোখের নিবিড় পাতা দুটি–কেমন যেন মোহ সৃষ্টি করে। গভীর রাতে এই রীণাই যখন ক্লান্ত, পরিতৃপ্ত হয়ে ঘুমোয় তখন কতদিন সঞ্জয় অন্ধকারে টর্চের আলো ফেলে নিঃশব্দে লোভীর মতো দেখেছে। আত্মপ্রসাদ লাভ করেছে।
আর আজ? সেই রীণাই ঘুমোচ্ছ। কিন্তু পাণ্ডুর মুখের ওপর কিসের যেন ছায়া। হঠাৎ দেখলে মনে হবে রীণা যেন তার দেহটা ফেলে কোথায় কত দূরে চলে গেছে।