ফলে দুপুরটা কাটানো এখন সমস্যা হয়ে উঠেছে। অবশ্য নতুন একটা অবলম্বন পেয়েছে শিবানন্দ ভট্টাচার্যের সেই ছবিখানা।
ইচ্ছে ছিল ওটা বাঁধিয়ে রাখবে। কিন্তু পরের জিনিস। হয়তো ফেরত দিতে হবে। তাই বাঁধাতে পারেনি।
না বাঁধালেও ছবিটা টেবিলের কাছে একটা তাকের ওপর রেখে রোজ দুপুরে ফুল-পাতা দিয়ে পুজো করে। কেন পুজো করে তা ও জানে না। তবে ওর কেমন মনে হয় এ মানুষ সাধারণ লোক নয়।
এই নিয়েও সঞ্জয় তাকে খুব ঠাট্টা করে। রীণা চুপ করে থাকে। পুরুষমানুষের সব কথায় কান দিলে চলে না।
কিন্তু নির্বাক ছবি নিয়েই বা কতক্ষণ ভুলে থাকা যায়? এক সময়ে শ্রান্তি আসে। তখনই আবার মনটা চঞ্চল হয়ে ওঠে।
আজও তেমনি হল। হঠাৎই একটা অস্থিরতা মনের ভেতর যেন কিরকম করছে। মনে হচ্ছে কিছু বুঝি ঘটতে চলেছে। বুঝি এখনই কারো জুতোর শব্দ পাওয়া যাবে সিঁড়িতে। কেউ বুঝি ভারী পা ফেলে ফেলে উঠে আসবে।
রীণা তখনই নিজেকে ঝটকা মেরে ঠিক করে নিতে চায়। এ সব কি আবোলতাবোল চিন্তা? কবে একদিন কী দেখেছিল সেই ভুলটাই শেষ পর্যন্ত পেয়ে বসল নাকি? শেষ পর্যন্ত একটা মানসিক ব্যাধির শিকার হয়ে দাঁড়াবে?
তখনই মনে পড়ল সেদিন রাত্তিরের ব্যাপারটা। সেটাও কি ভুল? সেটাও কি মানসিক বিকার?
ভাবতে ভাবতে রীণার হাত দুটো কিরকম ঠাণ্ডা হয়ে এল। কপালে চিনচিনে ঘাম। ও তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল।
সামনেই যশোর রোড। শে আষাঢ়ের মেঘলা আকাশ। বাস ছুটছে ঊর্ধ্বশ্বাসে। লোক হাঁটছে ফুটপাথ উপচে।
একটা নীল রঙের বাস চলে গেল। ওটা বোধহয় কোনো ইস্কুলের বাস। বাচ্চা ছেলেমেয়েদের কলকাকলি। আঃ! রীণা যেন নিশ্বাস নিয়ে বাঁচল। বাচ্চারাই সংসার ভরে রাখে, একমাত্র ওরাই পারে শোক-দুঃখ ভুলিয়ে দিতে। তার পুপুসোনাও একদিন এমনি করে বাসে চেপে ইস্কুলে যাবে।
এমনি সময়ে দরজায় শব্দ হলো–টুক-টুক। কে যেন অতি সন্তর্পণে দরজার কড়া নাড়ছে। রীণা চমকে উঠল।
কে? বলে সাড়া দিতে গেল। কিন্তু প্রথমে গলা থেকে স্বর বেরোল না।
তারপর অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ আর্তস্বরে চেঁচিয়ে উঠল–কে?
–আমি বন্দনা।
তাও ভালো। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল হঠাৎ বদনা কেন? ও তো বড়ো-একটা ওপরে আসে না। তবে কি কোনো ফোন–কোনো খারাপ খবর
রীণা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল।
–আপনার চিঠি।
চিঠি। চিঠি আবার এখানে কে দেবে? কেন দেবে?
চিঠি নিতে গিয়ে হাত কেঁপে উঠল।
–কার চিঠি?
কথাটা স্বগতোক্তি। কিন্তু বন্দনার মনে হল যেন তাকেই জিজ্ঞেস করছে। সে অবাক হয়ে রীণার দিকে একবার তাকাল। তারপর নিচে নেমে গেল।
এবার চিঠি খোলার পালা। কিছুতেই আর রীণা চিঠিটা খুলতে পারছিল না। কেবলই মনে হচ্ছিল কে লিখেছে? কী লিখেছে?
শেষ পর্যন্ত চিঠিটা খুলল। প্রথমেই দেখে নিল নামটা।–ও মান্তু! বাবাঃ। যা ভয় করেছিল।
চিঠিটা নিয়ে দরজা বন্ধ করে বিছানায় এসে বসল।
ভাই রীণা,
তোর চিঠি পেয়ে কী যে খুশি হয়েছি তা লিখে বোঝাতে পারব না।
কিছুদিনের জন্যে আমরা সকলে পুরী বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেইজন্যে চিঠির উত্তর দিতে দেরি হয়ে গেল। জানি আমার এই অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্যে কিছু মনে করবি না।
যাক, শেষ পর্যন্ত তুই কলকাতায় এলি। অনেক দিন পর আবার আমাদের দেখা হবে। অনেক গল্প জমে আছে।
কিন্তু তোর চিঠির শেষ দিকটার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারলাম না। কলকাতার মতো জায়গায় নির্জন দুপুরে কিসের এত ভয়? এ তো আর আমাদের দেশের বাড়ি নয়! তবু তো বাঙ্গুরের মতো জায়গায় চট করে বাড়ি পেয়ে গেছিস। ভাগ্য ভালো বলতে হবে।
একটা ভয় অবশ্য আছে, চোর-ডাকাতের। তার চেয়েও ভয় ঠগ-জোচ্চোরদের। কত ছুতো করেই-না ওরা বাড়ি বাড়ি ঢোকে। এসব ভয় এখন সব জায়গাতেই। খুব সাবধান। দরজা সব সময়ে বন্ধ করে রাখবি। সাড়া না নিয়ে দরজা খুলবি না। দরজায় আই-হোল নেই? না থাকলে ব্যবস্থা করে নিবি।
হ্যাঁ, তারপর লিখেছিস ম্যাজিক দেখতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলি। সেটা নিশ্চয় স্বাভাবিক কোনো কারণে। হয়তো তোর লো প্রেসার আছে। কিংবা অন্য কিছু। সে তো ভালো বলতে পারবে তোর নিজের ডাক্তার।
ছোটোবেলায় ম্যাজিক দেখতে গিয়ে নররাক্ষসের কথা হঠাৎ এতদিন পর মনে পড়ল কেন? নররাক্ষসের খেলা তো আমিও দেখেছিলাম। সত্যিই বীভৎস খেলা…
এই পর্যন্ত পড়েই রীণা আর পড়তে পারল না। শরীরটা কিরকম করে উঠল। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল।
.
সেই দিনই
মাঝরাতে হঠাৎ পুপু কেঁদে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে চমকে জেগে উঠল রীণা। এ সেই কান্না। যেন কিছুতে কামড়েছে।
রীণা তাড়াতাড়ি পুপুকে বুকে টেনে নিল। মায়ের বুকে নির্ভয় আশ্রয়ে থেকে কান্নাটা একটু কমল কিন্তু একেবারে থামল না।
রীণা পুপুকে চাপড়াতে চাপড়াতে ঘুম পাড়াতে লাগল বটে কিন্তু কান ছিল সজাগ। প্রতি মুহূর্তে একটা কিছুর প্রতীক্ষা।
কিসের প্রতীক্ষা?
একটু পরেই সেই শব্দ! নিচে কোথায় যেন কার ঘরের দেওয়ালে কে পেরেক পুঁতছে ঠকঠকঠক্–
ক্রমশ সেই শব্দটা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠল। কে যেন পেরেক নয়–কিছু একটা পুঁততে পুঁততে ওপরে উঠে আসছে।…
তারপরেই সব চুপ।
কিন্তু মিনিট পাঁচেক পরেই পরিষ্কার শুনতে পেল জুতোর শব্দ। বাইরের বন্ধ দরজার কাছে এসে শব্দটা থামল। সঙ্গে সঙ্গে পুপু আবার চিৎকার করে কেঁদে উঠল।