ইয়াকুব সাহেবকে খুঁজে বের করে তার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করব, এই আমার কাজ?
হুঁ।
খালা আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। কি ধরনের গল্পগুজব করব? দেশের রাজনীতি? হাসিনা-খালেদা সংবাদ?
খালা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, দাঁড়া, তোকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলি। পুরো ঘটনা না শুনলে তুই গুরুত্বটা বুঝবি না। আমাকে কথা দে যে দ্বিতীয় কেউ জানবে না। কসম কাট।
কসম কাটছি। কেউ জানবে না।
এইভাবে কেউ কসম কাটে? তোর কোন প্রিয় মানুষের নামে কসম কাট।
তামান্নার কসম। দ্বিতীয় কেউ জানবে না।
খালা অসম্ভব বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘তোর সবকিছু নিয়ে ফাজলামিটা আমার অসহ্য লাগে। তোকে খবর দিয়ে আনাই ভুল হয়েছে। তামান্নার নামে কসম কাটছিস কোন হিসেবে? ও তোর অতি প্ৰিয়জন হয়ে গেল?
তুমিও আমার অতি প্রিয়। তোমার নামে কসম কাটব?
থাক, কসম কাটতে হবে না। ঘটনাটা শোন –তোকে আল্লাহর দোহাই লাগে কেউ যেন না জানে।
কেউ জানবে না খালা। আপনি নিশ্চিন্ত মনে বলুন।
দরজা ভেজানোই ছিল। খালা উঠে গিয়ে লক করে দিলেন। এতেও তার মন ভাল না। তিনি আবার দরজা খুলে বাইরে উঁকি দিয়ে আবার দরজা বন্ধ করলেন। চেয়ার টেনে আমার কাছে নিয়ে এলেন। গলার স্বর আরো নামিয়ে ফেললেন, তোর খালুজান ছিল খুব বেষয়িক মানুষ। তার বিলি-ব্যবস্থা, হিসাব-নিকাশ খুব পরিষ্কার। তার মৃত্যুর পর টাকা-পয়সার কি করতে হবে না করতে হবে সব সে লিখে গেছে। উকিলকে দিয়ে সাক্ষি-সাবুদ দিয়ে উইল করে গেছে। সেই উইল ঘাঁটতে গিয়ে দেখি সর্বনাশ— ইয়াকুব নামের এক লোককে সে মালীবাগের বাড়ি আর নগদ দশ লাখ টাকা দিয়ে গেছে।
সে কি, কেন?
আমারো তো সেটাই প্রশ্ন— কেন? তোর খালুজানের কাছে সারাজীবনে একবার তার নাম শুনলাম না কোথাকার কোন ইয়াকুব —তাকে বাড়ি আর দশ লাখ টাকা। তোর খালুর কি ভীমরতি হয়েছে।
ভীমরতি-ফতি খালুজানের হবে না।
ঠিক বলেছিস সে ঐ টাইপের না। টাকা যখন দিয়েছে তখন কোন কারণেই দিয়েছে।
এ লোককে খুজে বার করা তোমার জন্যে খুব বোকামি হবে। ও আসবে বাড়ি আর নগদ টাকা নিয়ে ভ্যানিশ হয়ে যাবে। ভিনি ভিডি ভিসি।
গাধার মত কথা বলিস না তো হিমু। বাড়ি আর টাকা নেয়া অত সহজ— আমি শুধু জানতে চাই তোর খালুজানের সঙ্গে লোকটার সম্পর্ক কি ছিল? আমার ধারণা ফিসফাস কোন ব্যাপার?
ফিসফাস ব্যাপার মানে? ফিসফাসটা কি?
মেয়েঘটিত কিছু।
কিছুটা কি?
সেটা কি তার আমি জানি নাকি?
খালুজান যেমন মানুষ তাঁর তেমন ভীমরতি হওয়া সম্ভব না, তেমনি ফিসফাস
হওয়াও সম্ভব না।
পুরুষ মানুষের পক্ষে সবই সম্ভব। পুরুষ জাতি বড়ই আজব জাতি।
তাহলে আমার কাজ হচ্ছে ইয়াকুবকে খুঁজে বের করে তার পেটের ভেতর থেকে গল্প টেনে বের করে নিয়ে আসা।
হুঁ। পারবি না?
বুঝলি হিমু, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন-টিজ্ঞাপন দিয়ে লোকটাকে পাওয়া যেত, কেন বিজ্ঞাপন দিচ্ছি না— বুঝতেই পারছিস।
তা পারছি।
তুই এই উপকারটা আমার করা। লোকটাকে খুঁজে বের করা। আমি তোকে খুশি
করে দেব।
আচ্ছা।
খুজে বের করতে পারবি না?
মনে হয় পারব।
কিভাবে খুঁজবি?
নাম কি ইয়াকুব? নাম যদি ইয়াকুব না হয় তাহলে আমার কোন কথা নেই। আর নাম যদি ইয়াকুব হয় তাহলে আমার একটা কথা আছে। কথাটা হচ্ছে আপনার পিতার নাম कि?
হিমু।
কি খালা?
তুই তো মনে হয় আমার সঙ্গে ইয়ারকি করছিস। তোকে ইয়ারকি করার জন্যে আমি ডাকিনি। আমি খুব ভাল করে জানি ইয়াকুব নামের লোকটাকে খুঁজে বের করা তোর কাছে কোন ব্যাপার না। ইচ্ছা করলে তুই তিন দিনের মাথায় লোকটাকে বের করে ফেলবি। এই জন্যেই তোকে ডাকিয়েছি।
আচ্ছা ঠিক আছে।
তুই লোকটাকে খুঁজে বের করা। আমি কথা দিচ্ছি। তোকে খুশি করে দেব।
আমি তো সব সময় খুশি হয়েই আছি। তুমি এরচে বেশি খুশি কি করে করবে?
বললাম তো তোকে খুশি করব। কিভাবে করব সেটা তখন দেখবি।
আজ তাহলে বিদায় হই খালা?
আচ্ছা যা।
স্যান্ডেল চশমা এইসব রেখে যাই? তামান্নার সঙ্গে দেখা হবার সম্ভাবনা যখন হবে। তখন পরব। খালি পায়ে হেঁটে অভ্যাস হয়ে গেছে। স্যান্ডেল পায়ে পথে নামলে হুমড়ি খেয়ে চলন্ত ট্রাকের সামনে পড়ে যেতে পারি। তেমন কিছু ঘটলে ইয়াকুব সাহেবের সন্ধান পাবে না। সেটা ঠিক হবে না।
তোর যা ইচ্ছা করা। তোর কথাবার্তা একনাগাড়ে শোনা অসম্ভব ব্যাপার। তুই যে কি বলিস না বলিস তা বোধহয় তোর নিজেরো জানা নেই।
আমি স্যান্ডেল, চাদর, চশমা রেখে খালার বাড়ি থেকে বের হলাম। গেটের দারোয়ান সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে। আচ্ছা, এই দারোয়ানের নাম ইয়াকুব না তো? বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা। অনুসন্ধান খালার বাড়ির গেট থেকেই শুরু হোক। দারোয়ানের বয়স চল্লিশের উপরে। কাজেই তাকে সন্দেহভাজনদের তালিকায় রাখা যেতে পারে। আমি থমকে দাঁড়ালাম। দারোয়ানের কাছে এগিয়ে এসে বললাম, কে ইয়াকুব না? ইয়াকুব কেমন আছ? ভাল?
দারোয়ান থতমত খেয়ে বলল, স্যার আমার নাম কালাম।
ও আচ্ছা, কালাম তোমার চেহারা অবিকল ইয়াকুবের মত। সেই রকম নাক, সেই রকম মুখ। তোমার চোখও ইয়াকুবের মতই ট্যারা। ভাল কথা, ইয়াকুব নামে কাউকে চেন?
জ্বে না।
না চেনাই ভাল। ডেনজারাস লোক।
আমি লম্বা লম্বা পা ফেলে এগুচ্ছি। দারোয়ানের বিস্ময় এখনো কাটছে না। সে তাকিয়ে আছে। আচ্ছা, বিস্ময় নামক মানবিক আবেগ কত ধরনের হতে পারে? কি কি কারণে আমরা বিস্মিত হই?