হুঁ।
দাঁড়া, স্যান্ডেল কিনিয়ে দিচ্ছি। আচ্ছা শোন, এক কাজ কর, আমি বুলবুলকে বলে দিচ্ছি ও তোকে স্যান্ডেল কিনে দেবে। নাপিতের দোকান থেকে চুল কাটিয়ে আনবে। ভাল একটা পাঞ্জাবী কিনে দেবে। অসুবিধা আছে?
কোন অসুবিধা নেই।
খালা ম্যানেজারকে কি সব বললেন। নিচু গলায় বললেন, আমি কিছুই শুনলাম না।
ম্যানেজার সাহেব কমী মানুষ। তিনি প্রথমে আমার চুল কাটালেন। চুল কাটার সময় সামনে উপস্থিত থাকলেন এবং ক্রমাগত নাপিতকে ডিরেকশন দিতে লাগলেন— পেছনেরটা আরেকটু ছোট। সামনে বড়, জুলফি আরেকটু রোখ। চুল কাটাকে মনে হচ্ছিল শিল্পকর্ম এবং তিনি একজন মহান শিল্পনির্দেশক। মাথার চুলে পথের পাঁচালী বানানো হচ্ছে এবং তিনি সত্যজিৎ রায়।
চুল কাটার পর শ্যাম্পু করা হল, হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকানো হল। তারপর আমরা গেলাম স্যান্ডেল। কিনতে। নিউ এলিফ্যান্ট রোড থেকে মেড ইন ইটালী স্যান্ডেল কিনলাম। মাখনের মত মোলায়েম স্যান্ডেল। স্যান্ডেল জোড়া যেন গুণগুণ করে গাইছে, চরণ ধরিতে দিও গো আমারে… পায়জামা পাঞ্জাবী কেনা হল। পাঞ্জাবীর উপর ফেলে রাখার জন্যে চাদর। সুতির চাদর তবে সুন্দর কাজ আছে।
ম্যানেজার সাহেব বললেন, চলুন, চশমা কিনে দেই।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, চশমা কেন? আমার তো চোখ খারাপ না।
ম্যানেজার বিরক্ত মুখে বললেন, চোখ খারাপের চশমা না, গোটাপ চেঞ্জের চশমা। অনেক মানুষ আছে চশমা পরলে তাদের গোটাপে বিরাট পরিবর্তন হয়। যাদের চেহারায় মাংকি ভাব আছে — চশমা তাদের জন্যে মাষ্ট। মুখের অনেক— খানি ঢেকে ফেলে।
আমার চেহারায় মাংকি ভাব আছে তা জানতাম না। আমি শুধু বললাম, ও, আচ্ছা।
আপনি যেভাবে ও আচ্ছা বললেন তাতে মনে হল আপনি আমার কথা বিশ্বাস করলেন না। কথা সত্যি। গলায় টাই পরলে মানুষকে এক রকম লাগে, আবার টাইয়ের বদলে কাঁধে চাদর ফেললে অন্য রকম লাগে। তেমনি চশমা পরলে লাগবে এক রকম, চশমা না পরলে লাগবে আরেক রকম। সুন্দর ফ্রেম দেখে জিরো পাওয়ারের একটা চশমা কিনে দি চলুন।
চলুন।
আমি তোল পাল্টে ফেললাম। চশমা পারলাম। পাঞ্জাবী বদলে নতুন পাঞ্জাবী পারলাম। ডেসিং রুম ছিল না বলে পায়জামা বদলানো গেল না। কাঁধে ফেললাম চাদর। ম্যানেজার সাহেব ক্রিটিকের মত শুকনো গলায় বললেন, আপনাকে দেখতে ভাল লাগছে। বেশ ভাল লাগছে। প্রেজেন্টেবল। শুধু চুল কাটাটা তেমন ভাল হয়নি। আজকালকার নাপিত চুল কাটতে জানে না।
চলুন আরেকবার কেটে আসি। মনে আফসোস রাখা ঠিক না।
ম্যানেজার সাহেব বললেন, না থাক, দেরি হয়ে যাচ্ছে। চলুন যাই।
বাড়ি ফিরলাম। আমাকে দেখে ফাতেমা খালা মুগ্ধ গলায় বললেন, আরে তোকে তো চেনা যাচ্ছে না। তোর চেহারা থেকে চামচিকা ভাবটা মোটামুটি চলে গেছে।
আমি কদমবুচি করে ফেললাম। খালা বললেন, ওকি, সালাম করছিস কেন?
নতুন জাম-কাপড় পরেছি। এই জন্যে। তামান্না কি এসেছে খালা?
না। আজ আসবে না। ওর বাসায় সমস্যা হয়েছে। ওর ছোট ভাইটা রিকশা থেকে পরে সিরিয়াস ব্যথা পেয়েছে। তামান্না ওকে নিয়ে গেছে। হাসপাতালে। পুরো পরিবারটা মেয়েটার ঘাড়ে সিন্দাবাদের ভূতের মত চেপে আছে। একা সে কাদিক সামলাবে? দুৰ্গার মত তার তো আর চারটা হাত না, দুটা মোটে হাত।
খালা আমার মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে — এত ঝামেলা করে গোটাপ চেঞ্জ করা হল, কোন কাজে লাগল না। তামান্নার সঙ্গে দেখা হল না। এক কাজ করলে হয় না? ঠিকানা দাও বাসায় চলে যাই।
বাসায় গিয়ে কি কারবি?
তামান্নাকে বলব, আমাকে ফাতেমা খালা পাঠিয়েছেন। আপনার ছোট ভাই রিকশা থেকে পরে ব্যথা পেয়েছে— ঐ ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে বলেছেন। তামান্নার ছোট ভাইটার নাম কি খালা?
জামাল।
জামানের বয়স কত?
পাঁচ বছর।
জামানের জন্যে বেলুন-টেলুন জাতীয় কোন গিফট নিয়ে গেলে কেমন হয় খালা?
তুই কি সত্যি যাবি?
অবশ্যই।
যাক, তোর মধ্যে কিছু চেঞ্জ তাহলে এসেছে। আমি ভেবেছিলাম তুই আর বদলাবি না।
বাসার ঠিকানা দাও, রিকশা ভাড়া দাও ঘুরে আসি।
তামান্নার বাসায় উপস্থিত হওয়াটা বাড়াবাড়ি হবে। আমি ব্যবস্থা করব, তুই চিন্তা করিস না। যে জন্য তোকে ডেকে আনালাম সেটি তো বলা হল না।
কখন বলবে?
আয়, শোবার ঘরে আয় —বলি।
ফাতেমা খালার শোয়ার ঘরে আমি বসে আছি। খালা খাটে, আমি খাটের সঙ্গে লাগোয়া চেয়ারে। খালা কথা বলছেন ফিসফিস করে। দরজাও ভেজিয়ে দেয়া হয়েছে। ঘর আধো অন্ধকার। কেমন ষড়যন্ত্র ষড়যন্ত্র ভাব। মিলিটারী কু যখন হয় তখন সম্ভবত জেনারেলরা এইভাবেই কথা বলেন।
একজন লোককে তুই খুঁজে বের করব। লোকটার নাম ইয়াকুব। বাবার নাম সোলায়মান মিয়া। বয়স পঞ্চাশের উপর। তার স্থায়ী ঠিকানা আমার কাছে নেই। ঢাকায় যেখানে থাকতো সেই ঠিকানা আছে–অতীশ দীপংকর রোড। সেখানে এখন নেই। ম্যানেজারকে পাঠিয়েছিলাম। কোথায় গেছে তাও কেউ জানে না। তোর কাজ হচ্ছে ইয়াকুবকে খুঁজে বের করা। ঢোল পিটিয়ে খোঁজা যাবে না। চুপি চুপি খুঁজতে হবে।
তোমার ম্যানেজার যেখানে ফেল করেছে। সেখানে আমি পাশ করব কিভাবে।
তুই পাশ করবি। তোর কাজই তো পথে পথে ঘোরা। আর ইয়াকুব লোকটা খুব সম্ভব পথে পথেই থাকে।
যদি পাই কি করব? কানে ধরে তোমার কাছে নিয়ে আসব?
আমার কাছে আনতে হবে না। খবৰ্দর আমার কাছে আনবি না। তুই তার সঙ্গে গল্পগুজব করবি।