চা খেতে খেতে খালা পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে গেলেন। কোথায় শোক, কোথায় কি? সব জলে ভেসে গেল।
বুঝলি হিমু, তোর সঙ্গে কথা বলে আরাম আছে। তুই যে কোন কথা সহজভাবে নিতে পারিস, বেশির ভাগ মানুষ তা পারে না। একটা সাধারণ কথার দশটা বাঁকা অর্থ বের করে। এখন থেকে তুই আমাকে পরামর্শ দিবি, বুঝলি। তোর পরামর্শ আমার দরকার।
কি পরামর্শ?
তোর খালু মেলা টাকা রেখে গেছে। বিলি ব্যবস্থার ব্যাপার আছে।
কত রেখে গেছেন?
পুরোপুরি জানি না। আন্দাজ করতে পারছি। ভয়ে আমার হাত-পা পেটে ঢুকে যাচ্ছেরে হিমু।
কেন?
টাকাওয়ালা মানুষের দিকে সবার নজর। তাছাড়া আমি মেয়েমানুষ। তোর খালুর আত্মীয়-স্বজনরা এখন সব উদয় হবে। মড়া কান্না কাঁদতে কাঁদতে আসবে। তারপর সুযোগ বুঝে হায়েনার মত খুবলে ধরবে।
তুমি বড় হায়েনা হয়ে হাহা করে এমন হাসি দেবে যে হাসি শুনে ওরা পালাবার পথ পাবে না।
রসিকতা করিস না। সব দিন রসিকতা করা যায় না। এই বাড়িতে আজ একটা মানুষ মারা গেছে— এটা মনে রাখিস। এখনো কবরে নামেনি। আচ্ছা শোন— কুলখানির একটা ভাল আয়োজন করা দরকার না?
অবশ্যই দরকার। এমন খাওয়া আমরা খাওয়াব যে সবার পেটে অসুখ হয়ে যাবে। পরের এক সপ্তাহ ওরস্যালাইন খেতে হবে।
খালা গম্ভীর গলায় বললেন, হিমু তুই আবার ফাজলামি শুরু করেছিস। তোকে অসহ্য লাগছে। একটা মৃত মানুষের জন্যে তোর সম্মান থাকবে না? তুই কি অমানুষ?
ঠিক জানি না খালা। আমি কি তা পরে সবাই মিলে ঠিক করলেই হবে। আপাতত এসে কুলখানির মেনু ঠিক করি। তুমি কি খেতে চাও?
আমি কি খেতে চাই মানে? ফাজিল বেশি হয়েছিস। ধারাকে সারা জ্ঞান করছিস? আমার সঙ্গে রসিকতা। তুই এক্ষুনি বিদেয় হ। এই মুহূর্তে।
চলে যাব?
খালা রাগে জ্বলতে জ্বলতে বললেন, অবশ্যই চলে যাবি। আমি কি খেতে চাই জিজ্ঞেস করতে তোর মুখে বাধল না? শোন হিমু, আর কোনদিন তুই এ বাড়িতে আসবি না।
আমি খুবই সহজভাবে বললাম, তুমি ডাকলেও আসব না?
খালা তীব্র গলায় বললেন, না, আসবি না। তোর জন্যে এ বাড়ির দরজা বন্ধ। হাবার মত বসে আছিস কেন? চলে যেতে বললাম, চলে যা।
আমি চলে এলাম। খালা আর ডাকলেন না, আমিও গেলাম না।
দুবছর হয়ে গেল। ফাতেমা খালা কাঁটায় কাঁটায় দুবছর পর ডেকে পাঠিয়েছেন। আমি আবারো যাচ্ছি। তার মধ্যে কি পরিবর্তন দেখব কে জানে। ম্যানেজার সাহেবকে দেখে শংকিত বোধ করছি। মনে হচ্ছে বড় ধরনের পরিবর্তন দেখতে পাব। কে জানে, হয়ত দেখব। শাড়ি ফেলে দিয়ে স্কার্ট টপ ধরেছেন। চুল বব করিয়ে ফেলেছেন। মাথার সাদা চুলে আগে মেন্দি দিতেন। এখন সম্ভবত রিচ করাচ্ছেন।
ম্যানেজার সাহেব।
জ্বি।
ফাতেমা খালা –আপনার ম্যাডাম আছেন কেমন?
ভাল আছেন। গ্যাসের প্রবলেম হচ্ছে, চিকিৎসার জন্যে শিগগিরই সিঙ্গাপুর যাবেন।
গ্যাসের প্রবলেম মানে কি? পেটে গ্যাস হচ্ছে?
জ্বি।
খুবই দুঃসংবাদ। মেয়েদের পেটে গ্যাস একেবারেই মানায় না। গ্যাসের জন্যে সিঙ্গাপুর যেতে হচ্ছে?
গ্যাসটাকে তুচ্ছ করে দেখবেন না। গ্যাসের প্রবলেম থেকে অন্যান্য মেজর প্রবলেম দেখা দেয়। গ্যাস বেশি হলে উপরের দিকে ফুসফুসের ডায়াফ্রেমে চাপ দেয়, হার্টের ফাংশানে ইন্টারফেয়ার করে।
আমি বিস্মিত গলায় বললাম, ভাই আপনি তো মনে হচ্ছে জ্ঞানী ম্যানেজার। ডাক্তারীও জানেন।
ভদ্রলোক আমার রসিকতা পছন্দ করলেন না। গম্ভীর হয়ে গেলেন। সারা পথে তার সঙ্গে আমার আর কোন কথাবার্তা হল না। এবার একটা সিগারেট ধরিয়ে ছিলামম্যানেজার সাহেব কঠিন গলায় বললেন, গাড়িতে এসি চলছে। সিগারেট ফেলে দিন।
আমি বড়ই সুবোধ ছেলে হয়ে গেলাম। সিগারেট ফেলে দিলাম।
ফাতেমা খালাকে দেখে আমি ছোটখাট একটা চমক খেলাম। স্কার্ট টপ না, তিনি সাধারণ শাড়ি-ব্লাউজই পরে আছেন। সাধারণ মানে বেশ সাধারণ –সুতি শাড়ি। হালকা সবুজ রঙে সাদা সুতার কাজ করা। তার পরেও তাঁকে দেখে চমকাবার কারণ হচ্ছে তাঁকে খুকী খুকী দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে দশ বছর বয়স কমে গেছে। মুখ হাসি হাসি। পান খেয়েছেন বলে ঠোঁট লাল হয়ে আছে। সারা শরীরে সুখী সুখী ভাব। চোখে সোনালি
ফ্রেমের চশমা।
খালা বললেন, হা করে কি দেখছিস?
তোমাকে দেখছি। তোমার ব্যাপারটা কি?
কি ব্যাপার জানতে চাস?
তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
কেমন দেখাচ্ছে?
খুকী খুকী দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে দশ বছর বয়স কমিয়ে ফেলেছি।
ফজিলামি করিস না হিমু।
ফজিলামি করছি না। আমার এই হলুদ পাঞ্জাবীর শপথ, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তোমার বয়স কুড়ি বছর কমেছে।
একটু আগে তো বললি দশ বছর কমেছে।
শুরুতে দশ বছর মনে হচ্ছিল –এখন মনে হচ্ছে কুড়ি। ব্যাপারটা কি?
খালা আনন্দিত গলায় বললেন, ফুড হেবিট চেঞ্জ করেছি। এখন এক বেলা ভাত খাই। শুধু রাতে। তাও গাদা খানিক খাই না, চায়ের কাপের এক কাপ ভাত। আতপ চালের ভাত। দিনে শাকসব্জি, ফলমূল খাই। সেই সঙ্গে ভিটামিন।।
কি ভিটামিন?
ভিটামিন ই। এন্টি এজিং ভিটামিন। খুব কাজের। ভিটামিন ই ক্রম পাওয়া যায়। ঐ ক্রম মুখে মাখি। গুলশানে একটা হেলথ ক্লাবে ভর্তি হয়েছি। কী হ্যান্ড একসারসাইজ করি। একসারসাইজের পর সোয়ানা নেই। সোয়ানার পর আধঘণ্টা সুইমিং করি। সোয়ানাটা শরীরে ফ্যাট কমানের জন্যে খুব উপকার।
সোয়ানাটা কি?
স্টীম বাথ। দশ-পনেরো মিনিট ষ্টীম বাথ নিলে শরীর পুরোপুরি রিল্যাক্সড হয়ে যায়। টেনশন কমে। সুস্থ থাকার প্রধান রহস্য টেনশন ফ্রী থাকা।