বাড়িওয়ালা আমাকে ছাড়লেন না। চা বিসকিট খাওয়ালেন। দেশ যে মানুষের বদলে অমানুষে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে এই বিষয়ে তাঁর সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছে ছাড়া পেলাম। বাকি রইল। শুধু রূপা। রূপার কাছে যেতে ভয় ভয় করছে। সে কি বলবে কে জানে।
রূপা কার্ড হাতে নিয়ে হাসল। হাসতে হাসতে বলল, কার্ডটা খুব সুন্দর। তুমি কিনেছ?
না। আমার খালা কিনেছেন।
ধবধবে সাদা কার্ডে রূপালী লেখা। জোছনা জোছনা ভাব। তোমার বিয়েও তো দেখি পূর্ণিমা রাতে।
ঐ দিন পূর্ণিমা?
আজকাল জোছনার হিসাব রাখ না?
না।
আমি রাখি। তোমার বিয়ে পূর্ণিমার রাতেই হচ্ছে।
একসেলেন্ট। রূপা তুমি বিয়েতে যাচ্ছ তো?
রূপা আবারো হাসল। এমনিতে সে খুব কম হাসে। ছোটবেলায় কেউ বোধহয় তাকে বলেছিল— তাকে বিষণ্ণ অবস্থায় দেখতে ভাল লাগে। ব্যাপারটা তার মাথায় ঢুকে গেছে। সে সারাক্ষণ বিষণ্ণ থাকে। আজ হাসছে। এর মধ্যে তিনবার হাসল।
হাসছ কেন রূপা?
তুমি বদলে যাচ্ছ—এই জন্যে হাসছি। মানুষকে তুমি আগে ধোঁকা দিতে না। এখন দিচ্ছ।
কাকে ধোঁকা দিচ্ছি?
তামান্না নামের মেয়েটাকে দিচ্ছি। বিয়ের রাতে সবাই উপস্থিত হবে। তুমি হবে না। তুমি জোছনা দেখতে জঙ্গলে চলে যাবে। মেয়েটার কি হবে ভেবেছ কখনো?
এমন যদি আমি করি তামান্নার কিছুই হবে না। তামান্নার জন্যে একজন ষ্ট্যান্ডবাই বর আছে। ফাতেমা খালার ম্যানেজার বুলবুল সাহেব। তার সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাবে। বাকি জীবন দুজনে সুখেই কাটাবে।
ওরা দুজন বিয়ে করবে ভাল কথা— মাঝখানে তুমি জড়ালে কেন?
আমি না জড়ালে বিয়েটা হত না।
তোমার সমস্যা কি জান হিমু, তোমার সমস্যা হল নিজেকে তুমি খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে কর।
সেটা কি দোষের? সামান্য যে বালিকণা সেও নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করে।
বালির কণা এই কথা তোমাকে বলে গেছে?
হ্যাঁ।
রূপা আবারো হাসল। এই নিয়ে সে হাসল। চারবার। পঞ্চমবার হাসলেই ম্যাজিক নাম্বার পূর্ণ হবে। তখন আমাকে উঠে পড়তে হবে।
রূপা!
বল শুনছি।
অনেকদিন জোছনা দেখা হয় না। গাজীপুরের জঙ্গলে আমার সঙ্গে জোছনা দেখবে?
রূপা পঞ্চমবারের মত হেসে উঠে বলল, না।
হাত বাড়ালেই চাঁদ
ব্যাঙচি বলল, আমরা কোথায় যাচ্ছি?
আমি বললাম, গাজীপুরের শালবনে। জোছনা দেখব। জঙ্গলের জোছনা তুলনাহীন। একবার ঠিকমত দেখলে জোছনা মাথার ভেতর ঢুকে যায়। জীবনটা অন্য রকম হয়ে যায়।
আজ না তোর বিয়ে? আমি গিফট কিনে রেখেছি। তোর ভাবী পার্লার থেকে চুল বাঁধিয়ে এনেছে।
বিয়ে ভেঙ্গে গেছে।
সেকি?
ব্যাঙচি অসম্ভব মন খারাপ করল। সে মমতামাখা গলায় বলল, তোর ভাগ্যটা এত খারাপ কেন দোস্ত!
জানি না।
এই দেখ তোর জন্যে আমার চোখে পানি এসে গেছে।
আমার সঙ্গে জোছনা দেখতে জঙ্গলে যাবি?
অবশ্যই যাব। তুই যেখানে যেতে বলবি সেখানে যাব। তুই যদি নর্দমায় গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে বসে থাকতে বলিস তাই করব।
বিয়ে বাড়ির চমৎকার খাওয়া মিস করবি মন খারাপ লাগছে না?
না দোস্ত লাগছে না। মন খারাপ লাগছে তোর জন্যে। তোর ভাগ্য দেখি আমার চেয়েও খারাপ।
জোছনা দেখতে রওনা হবার আগে তামান্নার সঙ্গে কথা বললাম। কমিউনিটি সেন্টারে টেলিফোনে খুব সহজেই তাকে ধরা গেল। সে টেলিফোন তুলে প্রথম যে কথাটা বলল, তা হচ্ছে— আপনি আসছেন না, তাই না?
আমি বললাম, হ্যাঁ। তুমি যা চেয়েছিলে তাই হচ্ছে।
তামান্না বলল, শুনুন, আমি মত বদলেছি। আপনি আসুন। আপনাকে আগে অনেক কঠিন কঠিন কথা বলেছি তার জন্যে আমি লজ্জিত। প্লীজ আপনি আসুন।
ম্যানেজার বুলবুল সাহেব আছেন। তিনি তোমাকে খুবই পছন্দ করেন। তোমার বিয়ে হবে ম্যানেজার সাহেবের সঙ্গে।
আপনাকে কে বলল?
আমাকে কেউ বলেনি। তবে ম্যানেজার সাহেব ইচ্ছা পূরণ পাথরে হাত রেখে এই ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। পাথর তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ করেছে।
প্লীজ আপনি আমাকে রূপকথা শুনবেন না। পৃথিবীটা রূপকথা নয়।
কে বলল পৃথিবী রূপকথা নয়?
অপনি আসবেন না?
না। আজ আমার জোছনা দেখার নিমন্ত্রণ।
হিমু সাহেব শুনুন…।
আমি টেলিফোন রেখে দিলাম।
গাজীপুরের জঙ্গলে ঢোকার মুখে দেখি একটা প্রাইভেট কার দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ি নষ্ট। স্টার্ট নিচ্ছে না। এক ভদ্রলোক তার স্ত্রী এবং দুটা বড় বড় মেয়ে নিয়ে খুব বিপদে পড়েছেন। হাত উঁচিয়ে হাইওয়ের গাড়ি থামাতে চাইছেন। কোন গাড়ি থামছে না। বাংলাদেশের হাইওয়ের নিয়ম-কানুন পাল্টে গেছে। হাইওয়েতে গাড়ি চালাবার প্রথম নিয়ম হচ্ছে কোন বিপদগ্ৰস্ত পথে দেখলে গাড়ি থামাবে না। গাড়ি থামালেই বিপদগ্ৰস্তকে সাহায্য করতে হবে। তোমার দেরি হয়ে যাবে। তুমি নিজেও বিপদে পড়তে পোর। কি দরকার।
আমি ব্যাঙচিকে নিয়ে এগিয়ে গেলাম। ব্যাঙাচির বিশাল শরীর দেখে মেয়ে দুটি ভয়ে অস্থির হয়ে গেল। আমি ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বললাম, আপনাদের সমস্যা কি? গাড়ি ষ্টার্ট নিচ্ছে না?
ভদ্রলোক বললেন, না। আমি বললাম, আমার এই বন্ধু অটোমোবাইল ইনঞ্জিনিয়ার। গাড়ির বনেট খুলুন ও দেখুক।
ভদ্রলোক অনিচ্ছার সঙ্গে গাড়ির বনেট খুললেন। ব্যাঙচি প্ৰায় সঙ্গে সঙ্গেই গাড়ি সন্টার্ট করে দিল।
ভদ্রলোকের চোখে-মুখে কৃতজ্ঞতা। মেয়ে দুটি আনন্দে চেঁচাচ্ছে। ভদ্রলোকের স্ত্রী বললেন, ভাই, আমরা দু ঘন্টা ধরে জঙ্গলে পড়ে আছি। কি করে যে আপনাদের ঋণ শোধ করব।
আমি ভদ্রলোকের কাছে এগিয়ে গেলাম। গম্ভীর গলায় বললাম, স্যার আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন? ভদ্রলোক বিস্মিত গলায় বললেন, জ্বি না।