মরতে বসেছি হিমু সাহেব।
তই তো দেখছি।
ওসি রমনা থানা উঠে বসতে গিয়েও বসলেন না। আবার শুয়ে পড়লেন। বড় বড় করে শ্বাস নিতে লাগলেন। এই কয়েকদিনেই তার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়েছে। চোখে মুখে ঘুম ঘুম ভাব। ডাক্তাররা সম্ভবত ঘুমের অষুধের মধ্যেই তাঁকে রাখছে। চোখ কোটরে ঢুকে গেছে।
ভদ্রলোক কেবিনে সীট পাননি। তার দুপাশেই রোগীর সমুদ্র। এদের মধ্যে একজন বোধহয় মারা যাচ্ছে। ডাক্তার নার্স তাকে নিয়ে ছোটাছুটি করছে। আমি ওসি সাহেবের পাশে বসতে বসতে বললাম, আপনার হয়েছেটা কি বলুন দেখি।
স্টোক করেছে। বাঁ পাটা কোমরের নিচ থেকে অচল।
বলেন কি?
পুরো ভেজিটেবল হয়ে গেছি। নিজেকে মনে হচ্ছে চালকুমড়া।
ওসি সাহেব। আবারো উঠে বসতে গেলেন। আমি তাকে সাহায্য করলাম। পিঠের নিচে বালিশ দিয়ে দিলাম। ওসি সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, একটা মশা আমাকে খুব বিরক্ত করছে। মেরে দিন তো।
আমি মশা মেরে দিলাম। ওসি সাহেব মৃত মশার দিকে খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকলেন। কোন মৃত মশার দিকে এত কৌতূহল নিয়ে রোমান্স রসও তাকাননি। ওসি সাহেব মশার দিকে তাকিয়ে থেকেই বললেন, হিমু সাহেব। যেন আমি না, মশাটাই হিমু।
আমি বললাম, জ্বি।
আপনি এসেছেন। আমি খুব খুশি হয়েছি। আপনি কি একটা ব্যাপার জানেন? আমি যে মরতে বসেছি আপনার জন্যেই মরতে বসেছি।
আমি বললাম, জানি। আমার কথা শোনার জন্যে আপনার উপর প্রেসার তৈরি হল। সেই প্রেসারে স্ট্রোক। আপনার চাকরি আছে না, গেছে?
সাসপেনসনে আছি। চাকরি শেষ পর্যন্ত থাকবে বলে মনে হয় না।
অপরাধী যাদের ধরেছিলেন তারা কি ছাড়া পেয়েছে?
জ্বি না। তারা ছাড়া পায় নাই। তদন্তের ফলাফল এমন যে ছাড়া পাওয়া মুশকিল। তাছাড়া অস্ত্রসহ ধরা পড়েছে।
অনেকক্ষণ পর ওসি সাহেবের মুখে আনন্দের হাসি দেখা গেল।
হিমু সাহেব!
জ্বি।
আমি তো মরতে বসেছি কিন্তু আছি সুখে। অনেকদিন পর প্রথম বুঝলাম যে আমি মানুষ। এত ভাল লাগল। চাকরি চলে গেলে চলে যাবে–ভিক্ষা করব।
পা নষ্ট ভিক্ষা করার জন্যে ঘোড়া কিনতে হবে। ঘোড়ায় চড়ে ভিক্ষা।
ওসি সাহেব শব্দ করে হেসেই হাসি গিলে ফেললেন। হার্টের রোগীদের জেনারেল ওয়ার্ড শব্দ করে হাসির জায়গা না। অন্য রোগীরা অবাক হয়ে আমাদের দেখছে।
হিমু সাহেব!
জ্বি।
খুব ছোটবেলায় মা মারা গিয়েছিল। মায়ের চেহারা-টেহারা কিছুই মনে নেই। গতকাল রাতেই মাকে স্বপ্নে দেখলাম। মা বললেন, খোকন, তোর উপর আমি খুশি হয়েছি। তোর পা ঠিক হয়ে যাবে, পা নিয়ে দুশ্চিন্তা করিস না।
নানান ধরনের অপরাধ আপনি করতেন। অপরাধবোধ থেকে মুক্ত হওয়ায় এই স্বপ্ন দেখছেন।
আপনার যা ইচ্ছা। আপনি বলতে পারেন। ঘটনা যে কি তা আমি জানি।
ভাবী কোথায়?
ও বেবী এক্সপেক্ট করছে তো। এডভান্সড স্টেজ। প্ৰতিদিন আসতে পারে না।
ভাবী বেবী এক্সপেক্ট করছেন না-কি? উনাকে দেখে কিছু বোঝা যায়নি।
খুব সাবধানে নিজেকে আড়াল করে রাখে বলে কিছু বোঝা যায় না।
এটাই কি উনার প্রথম সন্তান?
এর আগে তিনটা সন্তান হয়েছে। তিনটা সন্তানই মৃত অবস্থায় হয়েছে। তবে এবারেরটা বাঁচবে। কি হিমু সাহেব, আপনি বলেন দেখি বাঁচবে না?
হ্যাঁ বাঁচবে।
আমি ঠিক করে রেখেছি ছেলে হলে নাম রাখব হিমু।
আপনার মেয়ে হবে।
মেয়ে হলে তার নাম হিমি।
ওসি সাহেব। আবারো শব্দ করে হাসলেন। এবার আর হাসি গিলে ফেললেন না। অন্যান্য বেডের রোগীরা উৎসুক চোখে তাকাচ্ছে। কেউ রাগ করছে না।
আমি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম, ওসি সাহেব কার্ডটা রাখুন।
ওসি সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, কিসের কার্ড?
বিয়ে করছি। বিয়ের কার্ড। আপনি অসুস্থ মানুষ যেতে পারবেন বলে মনে হয় না।
আপনি বিয়ে করবেন। আর আমি যাব না, তা কি করে হয়। আমি এম্বুলেন্সে করে হলেও আপনার বিয়েতে যাব।
সারাদিন আমি বিয়ের কার্ড দিয়ে বেড়ালাম। কেউ বাদ পড়ল না। ভিক্ষুক মেছকান্দর মিয়াও একটা কার্ড পেল। আমি বললাম, ভিক্ষুক সাহেব মনে করে যাবেন। কিন্তু। কাপড় চোপড় যা আছে তাতেই চলবে শুধু পাথরটা সঙ্গে নেবেন না। ডুপ্লিকেট হয়ে গেলে অসুবিধা আছে।
মেছকান্দর বিড় বিড় করে বলল, কি কন কিছুই বুঝি না।
আমি বিয়ে করছি বিয়ের দাওয়াত।
সােব আপনে বড় ত্যক্ত করেন।
আচ্ছা যাও আর তাক্তি করব না। ভাল কথা তোমার পাথর কিন্তু এখনো কিনতে পারি। লাস্ট প্রাইস কুড়ি হাজার টাকা।
পাথর বেচুম না।
বিয়ের দাওয়াত সবাইকে দিলাম। শুধু ইয়াকুব সাহেবকে পাওয়া গেল না। তাঁর
গেছেন। বাড়িওয়ালা বের হয়ে আমার সঙ্গে খুব হান্বিতম্বি করতে লাগল, আপনি যদি তার রিলেটিভ হন তাহলে খবর আছে। আপনার গলায় গামছা বেঁধে আমি টাকা আদায়
করব।
আমি বিনীতভাবে বললাম, আমিও আপনার মতই পাওনাদার। আজ আমাকে টাকা দেবার কথা।
আপনার কত টাকা গেছে?
প্ৰায় দশ হাজার।
কি রকম হারামজাদা লোক আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। মধুর ব্যবহার। যেদিন চলে যাবে সেদিনও আমাকে বাসায় ডেকে এনে চা খাইয়েছে। বাসার প্রতিটা জিনিস এর মধ্যে সরিয়ে ফেলেছে। কিছু বুঝতে পারি নাই। একটা ডাবল খাট ছিল সেই খাটও নাই।
বলেন কি?
এত বড় খাট কি করে সরাল সেটাই আমার মাথায় আসে না।
এডভান্স না রেখে বাড়ি ভাড়া দেয়া ঠিক হয় নাই।
অতি সত্য কথা বলেছেন। কথা দিয়ে তুলিয়ে ফেলেছে। আমার স্ত্রী এখন আমাকে নিয়ে হাসাহসি করে।
হাসাহাসি করারই কথা।