ভদ্রলোক আমি কি বলেছি না। শুনেই জবাব দিয়েছেন। লক্ষণ মোটেই ভাল মনে হচ্ছে না। আমি বললাম, আপনি ভাল আছেন?
জ্বি।
কোন কারণে কি মন খারাপ?
জ্বি না, মন ভাল। তামান্না ম্যাডামের সঙ্গে আছেন।
তামান্নার কথা কিছু জানতে চাইনি। আপনার কি হয়েছে বলুন তো?
শরীর ভাল যাচ্ছে না। ঘুমের সামান্য সমস্যা হচ্ছে।
ইচ্ছাপূরণ পাথরে হাত দিয়ে ঘুম চাইলেই হয়। ঘুমের অষুধ তো আপনার হাতের কাছে। হাত বাড়ালেই পাথর।
ম্যানেজার সাহেব বসে পড়েছেন। এখন তার দৃষ্টি ঘরের কার্পেট। কার্পেটের নকশার সৌন্দর্যে তার বিষণ্ণতা আরো বাড়ছে। আমি খালার সন্ধানে ভেতরে ঢুকে গেলাম। এ বাড়িতে এখন আমার অবাধ গতি— যে কোন ঘরে ঢুকে যেতে পারি। কাজের মেয়েগুলি চাপা রাগ নিয়ে তাকায় কিন্তু কিছু বলে না।
খালাকে তার শোবার ঘরে পাওয়া গেল। তিনি পা ছড়িয়ে বিছানায় বসে আছেন। একটা কাজের মেয়ে তার চুলের গোড়ায় তেল ডলে ডলে দিচ্ছে। প্রক্রিয়া যথেষ্টই জটিল। এক গোছা চুল আলাদা করে তুলে ধরা হয়। চুলের গোড়া ম্যাসাজ করা হয়। তেল দেয়া হয়। সেই চুলের গোছা ধরে পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণে কিছুক্ষণ টানাটানি করা হয়।
খালা ইশারায় খাটের উপর আমাকে বসতে বললেন। এবং ইশারাতেই কাজের মেয়েটিকে চলে যেতে বললেন। অতিরিক্ত ধনবানেরা ইশারা বিশারদ হয়ে যায়। এমনিতে সারাক্ষণ কথা কিন্তু আদেশ জারির ক্ষেত্রে চোখের বা হাতের ইশারা।
মাথার চুল সব পড়ে যাচ্ছে রে হিমু। খুব দুশ্চিন্তায় আছি।
দুশ্চিন্তার কি আছে? পাথরের কাছে চুল চাও।
সামান্য জিনিস চাইতে ইচ্ছা করে না। বড় কিছু হোক তখন চাইব। পাথর তো ঘরেই আছে। পালিয়ে যাচ্ছে না তো।
পাথর তোমার মনে ধরেছে? খালা সঙ্গে সঙ্গে গলার স্বর নামিয়ে বললেন, পাথর নিয়ে শুরুতে তোর একটা কথাও আমি বিশ্বাস করিনি। ব্যবহার করে আমি হতভম্ব।
কোন সাইড এফেক্ট নেই তো?
সাইড এফেক্ট আছে। তবে পজেটিভ সাইড এফেক্ট। আমার তো রাতে ঘুম হত না। পাথরটার কাছে ঘুম চাইলাম। এখন কোন অষুধ ছাড়া মড়ার মত ঘুমুচ্ছি। রাত দশটার সময় বিছানায় যাই। পুরানো অভ্যাসমত ভেড়া গুনতে শুরু করি। বললে বিশ্বাস করবি না চল্লিশটা ভেড়া গোনার আগেই ঘুম।
সাইড এফেক্ট কি?
বললাম না পজেটিভ সাইড এফেক্ট। যেসব জিনিস নিয়ে দুশ্চিন্তা হত সে সব নিয়ে এখন আর দুশ্চিন্তা হয় না। ঐ যে ইয়াকুবকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করতাম— তোর খালু কেন ঐ হারামজাদোটাকে এত টাকা দিয়ে গেল। এখন আর দুশ্চিন্তা হয় না। দিয়েছে ভাল করেছে।
ইয়াকুবের সঙ্গে কথা বলব না?
কোন দরকার নেই।
তোমার জীবন তো খালা টেনশান ফি হয়ে যাচ্ছে, তুমি বাঁচবে কি করে? এখন তো তুমি হুট করে মরে যাবে।
খামাখা কথা বলিসন তো হিমু।
বেঁচে থাকার জন্যে টেনশন লাগে খালা। যার যত টেনশন তাঁর বাঁচা তত আনন্দময়।
আমার টেনশন যথেষ্টই আছে। আমার টেনশান নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। বুলবুল বলছে চাকরি করবে না। আমি চোখে অন্ধকার দেখছি। বুলবুলের মত আরেকজন মাসে লাখ টাকা দিলেও পাব না।
বুলবুল সাহেব চাকরি করবে না কেন?
জানি না কেন, পরিষ্কার করে কিছুই বলছে না। সারাক্ষণ মুখ ভোঁতা করে থাকে।
পাথরকে বল বুলবুল যেন তোমাকে ছেড়ে না যায়।
তাই মনে হয় বলতে হবে। হিমু তুই পাথরটার খরচ নিয়ে যা। কত খরচ পড়ল?
পাথর উদ্ধারের ব্যাপারে একজনের সাহায্য নিয়েছি। বলতে গেলে সেই পাথর এনে দিয়েছে। তার নাম ছক্ক। ছক্কুর খুব শখ একটা ষ্টেশনারীর দোকান দেবে।
এ তো মেলা টাকার ব্যাপার।
পাথরটা কি তুমি দেখবে না?
আচ্ছা যা দোকান দিয়ে দেব। বুলবুলকে এখনি বলে দিচ্ছি সে সব ব্যবস্থা করে রাখবে।
আমি ছক্কুকে নিয়ে আসি?
যা নিয়ে আয়। আর দাওয়াতের কার্ডগুলি নিয়ে যা। তুই তোর বন্ধুবান্ধবকে দাওয়াত করবি না?
কার্ড সুন্দর হয়েছে খালা।
সুন্দর হবে না? কি বলিস তুই কার্ড আমি নিজে বেছে কিনেছি।
তামান্না কি আশপাশে আছে?
হ্যাঁ আছে। এখন ওর সঙ্গে আড্ডা দিতে যাবি না। বিয়ের আগে কনের সাথে দেখা সাক্ষাৎ হওয়া ঠিক না।
আমি শুধু একটা কথা বলে চলে যাব।
কি বলবি?
সেটা তো খালা তোমাকে বলা যাবে না।
কৌতূহলে খালার চোখ চকচক করছে। কি কথাটা বলা হবে তা জানার জন্যে তার মধ্যে টেনশন তৈরি হচ্ছে। টেনশন তৈরি হচ্ছে বলেই তিনি বেঁচে আনন্দ পাচ্ছেন।
খালার হাত থেকে দাওয়াতের কার্ড নিলাম। প্ৰথম কার্ডটা দিলাম তামান্নাকে। আমার বিয়ের নিমন্ত্রণ আমি আমার হবু স্ত্রীকে করব না? সেটাই তো স্বাভাবিক।
তামান্না গম্ভীর গলায় বলল, থ্যাংকস।
আমি বললাম, তুমি কেমন আছ তামান্না?
তামান্না বলল, ভাল।
তোমার ঘুম হচ্ছে তো? তামান্না কিছু বলল না। তার চোখে রাগ নেই, দুঃখবোধ নেই, অভিমান নেই। যেন সে পাথরের একটা মেয়ে। আমি দাওয়াতের কার্ড নিয়ে রওনা হলাম। কার্ডগুলি বিলি করতে হবে। কার্ড কাদের দেব ভাবতে ভাবতে যাচ্ছি—
ভিক্ষুক মেছকান্দার
ছক্কু
দেশ প্ৰেমিক জোবেদ আলি
ওসি রমনা থানা
ইয়াকুব সাহেব।
আচ্ছা রূপাকে একটা কার্ড দেব না? অবশ্যই দেব। সবার শেষে দেব। রূপাকে কার্ড দেবার পর যে কার্ডগুলি বাঁচবে সেগুলি কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলতে হবে।
আমাকে চিনতে পারছেন?
হিমু সাহেব না?
ঠিকই চিনেছেন। আমি আপনাকে চিনতে পারছিলাম না। আপনার একি অবস্থা?