তুমিই দাও। তোমার কাছে কত টাকা আছে তা তো জানি না। টাকা বুঝে অর্ডার দিতে হবে। কাপড় হিসেব করে জামা বানাতে হবে। আছে। হাফসার্টের মত কাপড়, তুমি বানিয়ে বসলে ফুল হাতা সার্ট, ডাবল পকেট তা হবে না।
তামান্না ভুরু কুঁচকে বলল, কেন আপনি অকারণে কথা বলছেন? আপনার নিজের ধারণ আপনি খুব মজা করে কথা বলছেন—আসলে তাও না। পুরানো সব কথা শুনতে খুবই বিরক্তি লাগছে।
কথা বলব না?
না।
একেবারেই না? তুমি প্রশ্ন করলে উত্তর দেব না— কি তাও দেব না?
তামান্না জবাব দিল না। সে বিরক্তির প্রায় শেষপ্রান্তে পৌছে যাচ্ছে। ভয়াবহ ধরনের বিরক্ত মানুষ অদ্ভুত সব আচরণ করে। আমাদের ধারণা রাগে-দুঃখে মানুষ কাঁদে। বিরক্ত হয়েও হাউ মাউ করে কাঁদতে আমি দেখেছি। বিরক্তের শেষ সীমায় নিয়ে গিয়ে আমার দেখতে ইচ্ছা করছে তামান্না কি করে। আমার বাবা মহাপুরুষ বানানোর বিখ্যাত কারিগর। তার উপদেশমালায় বলে গেছেন–
দুঃখী মানুষের কাছে থাকিও।
শোকগ্ৰস্ত মানুষের কাছে থাকিও।
রাগে অন্ধ মানুষের কাছে থাকিও।
আনন্দিত মানুষের কাছে থাকিও।
দুঃখ-শোক, রাগ-আনন্দ তোমার ভিতরে আসিতে পারিবে না।
কিন্তু কদাচ বিরক্ত মানুষের কাছে থাকিও না।
বিরক্ত মানুষ ভয়ংকর।
তামান্না এখন প্রচন্ড বিরক্ত কিন্তু তাকে মোটেই ভয়ংকর মনে হচ্ছে না। বরং সুন্দর লাগছে। চশমা। যেমন কাউকে কাউকে মানায় সবাইকে মানায় না, বিরক্তিও তেমন কাউকে কাউকে মানায়। তামান্নাকে খুব মানিয়েছে।
আমি খুবই নরম গলায় বললাম, তামান্না আমার জন্যে ছোট্ট একটা কাজ করে দেবো?
তামান্না কিছু বলল না। শুধু তার চোখ তীক্ষ্ণ করে ফেলল। আমি বললাম, তাকিয়ে দেখ জানালার কাছে যে প্রেমিক-প্রেমিকা যুগল বসেছে তাদের কাছ থেকে একটা সিগারেট এনে দেবে। তুমি চাইলেই দিয়ে দেবে।
ওদের কাছ থেকে সিগারেট এনে দিতে হবে?
আমিই চাইতাম। তবে আমি চাইলে নাও দিতে পারে। তোমার মত সুন্দরী কোন মেয়ে যদি সিগারেট ভিক্ষা চায় সে ভিক্ষা পাবেই।
তামান্না তার ব্যাগ খুলে একশ টাকার একটা নোট বের করে বেয়ারাকে সিগারেট আনতে পাঠাল। এক প্যাকেট সিগারেট একটা দেয়াশলাই। আমি বললাম, থ্যাংকস।
তামান্না বলল, থ্যাংকস ট্যাংকস কিছু দিতে হবে না। আপনি দয়া করে আর একটা কথাও বলবেন না।
আমি বললাম, আচ্ছা।
আমরা নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করলাম। খাওয়ার সময় তামান্না একবার জিজ্ঞেস করল, এদের রান্না তো ভালই, তাই না? আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। খাওয়ার শেষে তামান্না জিজ্ঞেস করল, আইসক্ৰীম খাবেন? আমি আবারো হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম।
তামান্না বলল, ম্যাডামের পাথরটা কি পাওয়া গেছে?
আমি না সূচক মাথা নাড়লাম। তামান্না বলল, প্রশ্ন করলে জবাব দিন। মাথা নাড়ানাড়ি অসহ্য লাগছে। ম্যাডামের পাথরটা জোগাড় হয়নি কেন?
মেছকান্দর মিয়াকে পাওয়া যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে পাথর নিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কোহিনূর হীরার আদি মালিককে যেমন এক দেশ থেকে আরেক দেশে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে মেছকান্দরের অবস্থা সে রকম হয়েছে। সে তার কোহিনূর নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
আপনার ধারণা পাথরটা কোহিনূরের মতই দামি?
কোহিনূরের চেয়েও দামী। কোহিনূরের ইচ্ছাপূরণ ক্ষমতা ছিল না। এর আছে।
কটা ইচ্ছা এই পাথর পূরণ করে? একটা না তিনটা?
সে ইচ্ছা পুরণ করতেই থাকে। এর ক্ষমতা এক এবং তিনে সীমাবদ্ধ নয়।
ভিক্ষুক মেছকান্দর মিয়ার কাটি ইচ্ছা এই পাথর পূর্ণ করেছে?
মেছকালর মিয়া কখনো কিছু চায় না বলে তার ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি। ভিক্ষুকরা নিজের জন্যে কিছু চায় না। শুধুই অনোর জন্যে চায়। ভিক্ষা করার সময় এরা কি বলে দয়া করে মন দিয়ে শুনবেন। এরা বলে, আল্লা আপনার ভাল করব বাবা। ধনে জনে বরকত দিব। এরা কখনো বলে না, আল্লা তুমি আমার ভাল কর, আমাকে ধন জন দাও।
আপনাকে শুনিয়ে না বললেও আড়ালে যে বলে না, তো কি করে জানেন?
আড়ালেও বলে না। এরা ধরেই নিয়েছে এই জাতীয় চাওয়া মূল্যহীন। তাদের মত অভাজনের ইচ্ছা পূর্ণ হবার নয়। কাজেই ইচ্ছা ব্যাপারটাই এদের জীবন থেকে চলে গেছে।
আপনি মনে হচ্ছে একজন ভিক্ষুক বিশেষজ্ঞ?
হ্যাঁ। প্রায়ই আমাকে যেহেতু ভিক্ষা করতে হয়। ওদের সাইকলজি আমি জানি।
আপনাকে প্রায়ই ভিক্ষা করতে হয়?
হ্যাঁ করতে হয়।
রাস্তায় কখনো হাত পেতে ভিক্ষা করেছেন?
করেছি। এক শবেবরাতের রাতে ভিক্ষা করে তিনশ একুশ টাকা পেয়েছিলাম। খরচ-টরচ দিয়ে হাতে ক্যাশ ছিল দুশ দশ টাকা।
খরচ-টরিচ মানে কি? কিসের খরচ?
অনেক কিছু নির্ভর করে। ভাল জায়গায় দখলের জন্যে টকা খাওয়াতে হয়। জায়গা বুক করার জন্যে টাকা তো লাগেই–ভিক্ষা করে যে টাকা আয় হয় তার উপর কমিশনও দিতে হয়।
আপনি কি সব সময় বানিয়ে বানিয়ে কথা বলেন?
মাঝে মাঝে বলি। সব সময় বলি না।
আমার তো ধারণা। আপনি সব সময়ই মিথ্যা কথা বলেন। আপনি একজন প্যাথলজিকেল লায়ার। এবং আমি নিশ্চিত আপনার কোন একটা মানসিক ব্যধি হয়েছে। যে কারণে আপনি সত্যি কথা বলতেই পারেন না।
হতে পারে।
অপনি কি আমার একটা উপদেশ দিয়া করে শুনবেন?
অবশ্যই শুনব।
আপনি একজন সাইকিয়াটিষ্টের সঙ্গে কথা বলুন। আপনার চিকিৎসা দরকার।
আমি বললাম, আচ্ছা।
আপনি যে একজন মানসিক রোগী তা কি জানেন?
জানি।
তামান্না উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, জানলেই ভাল। বেশিরভাগ মানসিক রোগীই জানে না যে তারা রোগী। সুস্থ মানুষের মত তারা ঘুরে বেড়ায়। খায়দায় ঘুমায়।