আমি খালার কথার স্রোতে বাধা দিয়ে বললাম, কুণ্ঠ নিরাময় কেন্দ্র থেকে ইয়াং দেখে একটা কুষ্ঠ রোগী ধরে নিয়ে আসব?
খালা ধমক দিলেন, অনেক ফাজলামী করেছিস আর না। শোন হিমু, তোদের বিয়ের সব শপিং আমি করব। বিয়ের শপিং করতে আমার সব সময় ভাল লাগে। ভাবছি কোলকাতায় চলে যাব। শাড়ি-গয়না কোলকাতা থেকে কেনাই ভাল। তবে দাদারা খুব ঠগবাজ। একবার যদি টের পেয়ে যায় আমি বাংলাদেশের দিদি, তাহলে সর্বনাশ। মোলায়েম করে চামড়া ছিলে ফেলবে। এত মোলায়েম করে চামড়া ছিলবে যে বোঝাই যাবে না। চামড়া ছিলছে, বরং মনে হবে গা ম্যাসাজ করে দিচ্ছে।
কোলকাতা কবে যাচ্ছ?
সামনের সপ্তায় যাব। ইচ্ছা করলে তুই আমার সঙ্গে যেতে পারিস। তবে না যাওয়াই ভাল। বিয়ের শপিংএ হবু স্বামীর থাকতে নেই।
ঠিক আছে, তুমিই যাও।
বউকে কোথায় রাখবি, কি খাওয়াবি এইসব নিয়ে তুই একেবারেই ভাববি না। প্রথম এক বছর আমার সঙ্গে থাকবে। তিনটা ঘর তোকে আমি আলাদা করে দিয়ে দেব।
এসি দেয়া ঘর তো খালা?
ছাগলের মত কথা বলিস কেন? আমার কোন ঘর কি আছে এসি ছাড়া?
তাও তো ঠিক।
তোর সঙ্গে বক বক করতে গিয়ে আসল কথাই ভুলে গেছি। পাথর কিনেছিস?
না।
খালা হতভম্ব হয়ে বললেন, না মানে? কি বলছিস তুই?
আমি করুণ গলায় বললাম, মেছকান্দর মিয়া পাথর নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে।
কী সর্বনাশ।
সর্বনাশ মানে মহা সর্বনাশ। আমি হাল ছাড়িনি। ঢাকা শহর চষে বেড়াচ্ছি।
গাড়ি লাগবে?
না, গাড়ি লাগবে না। পাজেরো জীপে করে ভিক্ষুক খোঁজা যায় না। তাছাড়া তোমার পাজেরো জীপের ড্রাইভার আমাকে পছন্দ করে না।
পছন্দ করবে কিভাবে, তুই তাকে এক বাড়ির সামনে দাঁড়া করিয়ে উধাও হয়ে গেলি। বেচারা রাত সাড়ে তিনটা পর্যন্ত তোর জন্যে অপেক্ষা করেছে। এসব উদ্ভট কান্ডকারখানা কেন করিস? এই বেচারাকে রাত তিনটা পর্যন্ত শুধু শুধু বসিয়ে রাখলি।
আর রাখব না। গাড়িটা তুমি পাঠিয়ে দিও।
একটু আগে না বললি গাড়ি লাগবে না।
এখন মনে হচ্ছে লাগবে। খালা গাড়িটা তুমি সারারাতের জন্যে দিও। ভিক্ষুকদের
পাথরটা হাতছাড়া হয়ে গেছে বুঝতে পারিনি। রাগে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে।
পাথর তুমি পাবে। একশ পারসেন্ট গ্যারান্টি।
পাথরটার কাছে যা চাওয়া যায়। তাই পাওয়া যায়।
অবশ্যই। তবে সামান্য কিন্তু আছে।
কিন্তু আবার কি?
মাংকিস প গল্পটা জান না খালা— ঐ যে একটা বান্দরের থাবা ছিল, ঐ থাবাটার কাছে যা চাওয়া যেত তাই পাওয়া যেত। সমস্যা একটাই—ইচ্ছা পূর্ণ হবার পর পরই ভয়ংকর বিপদ হত।
বলিস কি? এত খাল কেটে কুমীর আনা।
পাথর প্রজেক্ট বাদ দিয়ে দি?
না না। আমার পাথর লাগবে। পাথর ছাড়া চলবে না। বিরাট ভুল করেছি। — আসলে ঐ দিনই কিনে ফেলা উচিত ছিল।
ইয়াকুব প্রজেক্ট কি বাদ?
খালা বিরক্ত গলায় বললেন, ইয়াকুব তো পালিয়ে যাচ্ছে না। তুই পাথরটা আগে
জোগাড় কর।
পাথর তোমার চাই-ই?
অবশ্যই চাই।
মনে হচ্ছে কিছু খরচাপাতি করতে হবে।
খরচাপাতি তো করবই। না করেছি? এখন কত লাগবে বল, ড্রাইভারের সঙ্গে পাঠিয়ে দি।
এখন লাগবে না। প্রজেক্ট শেষ হোক। তারপর তোমার নামে বিল করব।
রাত আটটায় ওসি সাহেবের বাসায় যাবার কথা। আমরা আটটার আগেই উপস্থিত। হলাম। ওসি সাহেবরা থানার সঙ্গে লাগোয়া সরকারী বাসায় থাকেন বলে শুনেছি—এই বাড়িটা তা না। কলাবাগানে এ্যাপার্টমেন্ট হাউস। কলিংবেল টিপতেই রোগা একজন মহিলা দরজা খুললেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ আগে একটা ভয়ের স্বপ্ন দেখে তার ঘুম ভেঙ্গেছে। ভয় এখনো কাটেনি। আমাদের দুজনকে দেখে ভয় আরো যেন বাড়ল।
আমি বললাম, ওসি সাহেব কি বাসায় আছেন?
মহিলা শংকিত গলায় বললেন, জি না। আপনার নাম কি হিমু?
জ্বি না, তবে ও আপনার কথা বলেছে। পাঁচজন আসার কথা না?
আমার বন্ধুকে নিয়ে এসেছি। ও একাই চারজন —আর আমি এক পাঁচ।
আমার রসিকতায় কাজ হল না। ভদ্রমহিলা ভীত গলায় বললেন, ওর আসতে একটু দেরি হবে। কি একটা কাজে আটকা পড়ে গেছে। আপনারা বসুন।
আমরা বসলাম। ভদ্রমহিলা বললেন, চা দিতে বলি?
ব্যাঙচি চিন্তিত চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে। যে অতিথি ডিনারের নিমন্ত্রণে এসেছে চা দিতে বললে সেই অতিথি একটু ভড়কে যাবেই। আমি বললাম, ওসি সাহেব আমাদের ডিনারের দাওয়াত করেছিলেন।
জ্বি, আমি জানি। ও কোন বাজার করেনি। খুব জরুরী কি একটা কাজে আটকা পড়েছে। ও রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার নিয়ে আসবে। আপনাদের বসতে বলেছে।
আমরা বসছি।
চা দেব?
দিতে পারেন।
অনেকক্ষন অপেক্ষা করার পর কাজের একটি মেয়ে দু কাপ চা এবং পিরিচে করে। খানিকট চানাচুর দিয়ে গেল।
ব্যাঙচি ফিসফিস করে বলল, চানাচুর খাওয়া ঠিক হবে না। ক্ষিধে নষ্ট হবে।
আমি বললাম, বেছে বেছে দু একটা বাদাম খেতে পারিস।
ব্যাঙচি চারদিকে তাকাতে তাকাতে বলল, বিকেলে কিছু না খাওয়ায় ক্ষিধেটা নাড়িতে চলে গেছে। যাই দেখছি তাই খেয়ে ফেলতে ইচ্ছা করছে।
সৌফা চেয়ার ছাড়া তো এই ঘরে কিছু নেই। সোফা খাবি?
ব্যাঙচি কিছু বলল না। যেভাবে সোফার দিকে তাকাচ্ছে তাতে মনে হয় সোফা খাবার ব্যাপারটা সে বিবেচনায় রেখেছে। একেবারেই যে অগ্রাহ্য করছে তা না।
রাত এগারোটা বেজে গেল। ওসি সাহেবের স্ত্রী বড় বাটিতে করে এক বাটি পায়েস এবং পিরিচ চামচ দিয়ে গেলেন। আগের মতই ভীত গলায় বললেন, ও এতো দেরি করছে কেন বুঝতে পারছি না। কখনো এ রকম করে না। দয়া করে আর কিছুক্ষণ বসুন। আপনাদের নিশ্চয়ই ক্ষিধে পেয়েছে, পায়েস খান। ঘরে বানানো। কাওনের চাউলের পায়েস।