আমার চারজন বন্ধু নিয়ে ওসি সাহেবের বাসায় যাবার কথা। আমি ঠিক করে। রেখেছি। চারজন বন্ধু না, শুধু ব্যাঙচিকে নিয়ে যাব। পাঁচজনের জন্যে রান্না করা থাকলে তার হয়ে যাবার কথা। তারপরও যদি শর্ট পরে রীনা ভাবী নিশ্চয়ই দশ বারোটা পরোটা চট চট ভেজে দিয়ে দেবে।
মহিলারা ক্ষুধার্ত মানুষকে খাইয়ে আনন্দ পায় তবে সেই ক্ষুধার্ত মানুষকে হতদরিদ্র হলে চলবে না। ভিখিরী বারান্দায় খেতে বসে এক পর্যায়ে যদি ক্ষীণ গলায় বলে, আম্মাজী ভাত শেষ, আর চাইরটা ভাত দেন তাহলে গৃহিণী বলবেন, আর ভাত নাই। তোমার জন্য লংগারখানা খোলা হয় নাই।
জোবেদ সাহেবের দোকানো গেলাম টেলিফোন করতে। ব্যাঙচিকে দাওয়াতের কথা বলতে হবে। ফাতেমা খালাকেও জানাতে হবে যে পাথর পাওয়া যায়নি। অনুসন্ধান চলছে। যে কোন তুচ্ছ ব্যাপারে দুঃশ্চিন্তা করে ফাতেমা খালা অসুখ বধিয়ে ফেলেন। পাথর এখনো পাওয়া যায়নি এই চিন্তায় তার ডায়রিয়া হয়ে যাওয়া উচিত।
জোবেদ সাহেবের দোকান যথারীতি খালি। মাছিও উড়ছে না। তিনি আমাকে দেখে বিরস মুখে বললেন, হিমু সাহেব আপনার কাছে অনেক পাওনা হয়ে গেল। আমি হাসি। মুখে বললাম, টাকা পেয়েছি। কুড়ি হাজার টাকা, এইবার আপনার পাওনা মিটিয়ে দেব। টাকা আনতে ভুলে গেছি।
আজকালের মধ্যে পেলে সুবিধা হত।
আজই পাবেন। রাতে আমার এক জায়গায় দাওয়াত আছে। যাওয়ার পথে দিয়ে যাব। টেলিফোনটা কি ঠিক আছে?
জোবেদ সাহেব নিতান্ত অনিচ্ছায় বললেন, ঠিক আছে। আমি তার পাওনা মিটিয়ে দেব এই কথা তিনি বিশ্বাস করেননি। কোন পাওনাদার যখন দিনক্ষণ উল্লেখ করে। বলে এই দিনে টাকা দিয়ে দেব তখন অবধারিতভাবে জানতে হবে টাকাটা পাওয়া যাচ্ছে না।
চা খাবেন হিমু সাহেব?
জ্বি।
আপনাকে এই নিয়ে মোট কতকাপ চা খাইয়েছি জানেন?
জ্বি না।
আজকেরটা নিয়ে নয়শ আঠারো কাপ।
আপনি আমাকে ককাপ চা খাওয়াচ্ছেন তারও হিসাব রাখছেন?
জোবেদ সাহেব ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, দোকানদার মানুষ, হিসাব করা হচ্ছে আমার অভ্যাস। তাছাড়া ব্যবসাপাতি নাই, কাজ কর্ম নাই। ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকলে ফালতু চায়ের কাপের হিসাব করতাম না।
নয়শ আঠারো নম্বর চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আমি টেলিফোনে কথা বলছি। ব্যাঙচিকে পাওয়া যায়নি, কথা বলছেন মহিলা ব্যাঙাচি।
ভাবী আমাকে কি চিনতে পারছেন? আমি. . .?
হ্যাঁ চিনতে পারছি। আপনি গতরাতে এসেছিলেন। আপনি চলে যাবার তিন-চার মিনিটের মাথায় ও এসেছে। এসে যেই শুনেছে আপনি ওর খোঁজ করতে বের হয়েছেন ওমনি সে আবার বের হয়েছে। ফিরেছে রাত একটায়।
বলেন কি?
ভাল মানুষের মত ফেরেনি, মারধর খেয়ে ফিরেছে।
সেকি, মারধর কে করেছে?
হাইজ্যাকাররা ধরেছিল। টাকা পয়সা না পেয়ে চড় থাপ্লর মেরেছে। চবিওয়ালা মানুষ –মারলে আরাম লাগে। ওরা মনের সুখে মেরেছে। তাও ভাল চড় থাপ্পরের উপর দিয়ে গিয়েছে। পেটে ক্ষুর বসিয়ে দিলে পারত। পারত না?
অবশ্যই পারত। ভাবী, ওকি আশপাশে আছে?
হ্যাঁ আছে। ঘুমুচ্ছে। খুব ভয় পেয়েছিলাম। রাতে ঘুম হয়নি। সূর্য উঠার পর ঘুমুতে গেছে। ওকে কি ডাকব?
না, ডাকার দরকার নেই। ঘুমুক। ওকে শুধু বলবেন রাত আটটার আগে খালি পেটে যেন আমার মেসে চলে আসে। ওর চিকিৎসা শুরু করেছি-প্ৰথম ডোজটা আজ পড়বে।
কি ধরনের চিকিৎসা করছেন?
জগাখিচুড়ি টাইপ। টোটকা তন্ত্রমন্ত্র মিলিয়ে একটা চিকিৎসা।
আপনার কি ধারণা কাজ হবে?
অবশ্যই কাজ হবে।
আমি তাকে অবশ্যই আটটার আগে পাঠায়ে দেব।
বিকেলে যেন নাশতা টাসতা কিছু না খায়। দুপুরে খেতে পারে। কিন্তু সূর্য ডোবার পর কিছু মুখে দেয়া যাবে না।
আমি বলে দেখব। তাতে লাভ হবে কিনা জানি না। আমি চোখের আড়াল হলেই কিছু না কিছু খাবে। সোয়াবিন তেল যে খেতে পারে সে সবকিছুই খেতে পারে। মাঝে মাঝে আমার কি মনে হয় জানেন? মাঝে মাঝে মনে হয় –কেউ যদি আমাকে কেটে কুটে রাঁধত। ঝাল দিয়ে ভালমত কষিয়ে একটা বড় জামবাটিতে ওর সামনে দিয়ে বলত, এটা হল তোমার রান্না করা স্ত্রী। আপনার বন্ধু কিন্তু তারপরও খেয়ে ফেলত।
আমি হা হা করে হাসলাম। তবে আমার হাসি তেমন জমল না। শব্দটা ঠোঁটে হল। এবং ঠোঁটেই ঝুলে রইল। আমার মনে হচ্ছে মহিলার কথা ভুল না। ব্যাঙচি ঠিকই জামবাটি শেষ করে নিচু গলায় বলবে, তরকারি কি আরো আছে? রানের গোশত পাওয়া যাবে?
নয়শ উনিশ নম্বর চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ফাতেমা খালার সঙ্গে কথা হল। খালা এমিতেই উত্তেজিত থাকেন আজ তার উত্তেজনা সীমাহীন। ভালমত কথাই বলতে পারছেন না, কথা গলায় আটকে যাচ্ছে। একসঙ্গে অনেকগুলি কথা বলতে চাচ্ছেন। পারছেন না। মানুষের মস্তিষ্ক এক সঙ্গে অনেকগুলি কথা তৈরি করতে পারে। কিন্তু মুখে বলতে পারে না। কথা বলার জন্যে দুটা মুখ থাকলে ভাল হত বোধহয়। একটা মুখ থাকবে শুধু সত্যি কথা বলার জন্যে। আরেকটা মুখ সত্য-মিথ্যা সবই বলবে। আদালতে সাক্ষী দেবার জন্যে সত্যবাদী মুখ ব্যবহার করতে হবে। অন্যমুখ কখনোই ব্যবহার করা না।
ফাতেমা খালা হড়বড় করে কথা বলে যাচ্ছেন। আমি রিসিভার কানে লাগিয়ে নয়শ উনিশ নম্বর চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি। চা ভাল হয়েছে। আজ মনে হয় নয়শ বিশ পূর্ণ করতে হবে।
তোর জন্যে একটা মারাত্মক খবর আছে রে হিমু। তুই বিশ্বাসও করতে পারবি না। কত মারাত্মক। তামান্নাকে শেষ পর্যন্ত বিয়ের কথা বললাম। সে রাজি হয়েছে। আমার আশংকা ছিল বোধহয় রাজি হবে না। তুই ষাঁড়ের গোবর হলেও তোর মধ্যে কিছু মজার ব্যাপার আছে। তামান্না বুদ্ধিমতী মেয়ে তো, সে ব্যাপারটা ধরেছে। তবে তোমান্না যে বলতেই রাজি হয়ে যাবে ভাবিনি। আমি তামান্নার মার সঙ্গেও কথা বলেছি। তিনি বললেন, তামান্নার আসল মা তো আমি না, আপনি যা বলবেন তাই হবে। আপনি যদি পথ থেকে কোন কুণ্ঠরোগী ধরে নিয়ে এসে বলেন, এর সঙ্গে তামান্নার বিয়ে। আমি তখনও বলব, শুকুর। আলহামদুলিল্লাহ।