আশপাশের কোন রেস্টুরেন্টে ব্যাঙচিকে পাওয়া গেল না। ব্যাঙচি নেই— আমার পাজেরোও নেই। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে ভেগেছে।
আমি হেঁটে হেঁটে মেসে ফিরলাম। ব্যাঙচিকে যে পাইনি সেই খবরটাও তার স্ত্রীকে দিয়ে এলাম না। বেচারীর বিষণ্ণ মুখ দেখতে ইচ্ছা করছে না।
তামান্না ডাকছে
তামান্না গায়ে হাত দিয়ে আমাকে ডাকছে, হিমু ভাইয়া। হিমু ভাইয়া। এত আদর করে অনেক দিন কেউ আমাকে ডাকেনি। এটা যে বাস্তব কিছু না, স্বপ্ন দৃশ্য সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেললাম। গায়ে হাত দিয়ে তামান্না আমাকে ডাকবে না। এত আবেগ দিয়ে ভাইয়াও ডাকবে না। ভাইয়া সরাসরি উচ্চারণ করছে না –দুটা চন্দ্ৰবিন্দু যুক্ত করেছে। আবেগ মিশ্রিত চন্দ্ৰবিন্দু— হিমু ভাঁইয়াঁ। হিমু ভাঁইয়াঁ।
আমি এখন দুটা জিনিস করতে পারি, ঘুম না ভাঙ্গিয়ে স্বপ্নটাকে লম্বা করতে পারি। কিংবা জেগে উঠতে পারি। ঘুমের মধ্যেই দেটািনায় পড়ে গেলাম। তামান্না ডেকে যেতে লাগল, হিমু ভাইয়াঁ। হিমু ভাইয়াঁ। গায়ে ধাক্কার পরিমাণও বাড়তে লাগল। ঘুম ভাঙ্গল। বেলা অনেক হয়েছে, ঘরে রোদ ঢুকে গেছে। বিছানার কাছে মেসের ম্যানেজার সরফরাজ খাঁ দাঁড়িয়ে। চিকন গলায় তিনিই এতক্ষণ ডাকাডাকি করছিলেন। তিনি ডাকছেন— হিমু ভাই। আমার মস্তিষ্ক ভাই ডাকটা বদলে ভাইয়া করে ফেলছে।
আমি বিছানায় উঠে বসলাম। ঘুম ভাঙ্গার পর পর মানুষ কিছু কান্ডকারখানা করে— আড়মােড়া ভাঙ্গে, হাই তোলে, চোখ ভলে এবং আবারো ঘুমের সুখ স্মৃতি কল্পনা করার জন্যে কিছুক্ষণের জন্য হলেও চোখ বন্ধ করে ফেলে। আমি তার কিছুই না করে মেস ম্যানেজারের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম, আমাদের সোনার বাংলা শ্মশান হতে কত বাকি?
মেস ম্যানেজার শ্রেণীর মানুষ যাদের প্রধান কাজ দিনে আট ন ঘন্টা কাঠের চেয়ারে বসে থাকা তারা সাধারণত খুব রাজনীতি সচেতন হন। সোনার দেশ কেন শ্মশান হচ্ছে এই নিয়ে তারা খুব ভাবিত থাকেন। সরফরাজ খাঁ সাহেব তার জ্বলন্ত উদাহরণ। সোনার বাংলার ভবিষ্যৎ নিয়ে তার চেয়ে বেশি চিন্তা শেখ হাসিনা কিংবা বেগম জিয়া কেউ করেন বলে মনে হয় না।
এক দুপুরে ঘামে ভিজে ক্লান্ত হয়ে মেসে ফিরেছি। দেখি চোখ-মুখ শক্ত করে। সরফরাজ খাঁ সাহেব কাঠের চেয়ারে বসে আছেন। তাঁকে খুবই বিমর্ষ এবং চিন্তিত মনে হচ্ছে। তিনি চোখের ইশারায় আমাকে ডাকলেন। আমি কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই বললেন, হিমু সাহেব, সোনার বাংলা যে শ্মশান হয়ে গেল সেটা জানেন?
আমি বললাম, পুরোটাই কি শ্মশান হয়ে গেছে না পার্ট বাই পার্ট হচ্ছে?
পুরোটাই শ্মশান হয়ে গেছে।
আমি বললাম, তাহলে তো হিন্দু ভাইদের জন্যে খুব সুবিধা হল। তারা যেখানে সেখানে মড়া পোড়াতে পারবে। মড়া নিয়ে এখন আর শ্মশান খুঁজতে হবে না। যে কোন জায়গায় মড়া চিৎ করে শুইয়ে হা করে মুখে আগুন দিয়ে দিলেই হল।
সরফরাজ খাঁ আহত চোখে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে শান্তগলায় বললেন, ঠিক আছে হিমু সাহেব ঘরে যান। আপনার সঙ্গে কোন আলোচনায় যাওয়াটাই ভুল।
আমি ভেবেছিলাম সোনার বাংলা শ্মশান হওয়া সংক্রান্ত প্রশ্ন শুনে আজও তিনি আহত চোখে তাকাবেন। তা করলেন না। মনে হয় আমার প্রশ্ন তার মাথায় ঢুকেনি। তিনি আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ভীত গলায় ফিসফিস করে বললেন, পুলিশ এসেছে। আমিও পুলিশ।
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, আমাকে এ্যারেষ্ট করতে এসেছে?
সে রকমই মনে হচ্ছে। পুলিশের একটা জীপ দাঁড়িয়ে আছে মেসের সামনে। পুলিশরা কেউ জীপ থেকে নামেনি। শুধু ওসি সাহেব নেমেছেন। ভয়ংকর রাগী চেহারা।
উনি কোথায়?
স্যারকে আমার ঘরে বসেয়েছি। চা দিয়েছি। নিমক পরা আনিয়েছি। এক প্যাকেট বেনসন আনিয়ে দিয়েছি।
চা-সিগারেট খাচ্ছে?
এখন কথা বাড়াবেন না। পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে নিচে চলুন। আপনাকে নিয়ে খুবই টেনশনে থাকি হিমু সাহেব। সাতটা বাজেনি এর মধ্যে পুলিশ এসে উপস্থিত। করেছেন কি আপনি?
মন্ত্রীর এক শালাবাবুকে মুখ ভেংচি দিয়েছিলাম। সেই মামলাটা ডিসমিস হয়ে গেছে
জানতাম।
সরফরাজ খাঁ চিন্তিত গলায় বললেন, এত লোক থাকতে মন্ত্রীর শালাকে মুখ ভেংচি দিলেন কেন? বাংলাদেশে কি ভেংচি দেয়ার লোকের অভাব আছে? তের কোটি মানুষ। পনেরো হাজার লোক বাদ দিয়ে বাকি বারো কোটি পচাঁশি লাখ লোককে ভেংচি দিতে পারেন।
রমনা থানার ওসি সাহেব ম্যানেজারের চেয়ারে বসে আছেন। তাঁর সামনে বেনসনের প্যাকেট পড়ে আছে। প্যাকেট খোলা হয়নি। চায়ের কাপও চুমুক দেয়া। চায়ে সর পড়ে গেছে। ওসি সাহেব পুরনো অভ্যাস মত জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটছেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে ভয়ংকর কিছু ঘটে গেছে। ঘুষ পাওয়া যায় না। এমন অঞ্চলে পৌষ্টিং হয়ে গেছে— নিঝুম দ্বীপ টিপের দিকে। আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে বললাম, স্যার কেমন আছেন?
ওসি সাহেব আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সরফরাজ খাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
সরফরাজ খাঁ দ্রুত ঘর থেকে বের হতে গিয়ে দরজায় প্রচন্ড ধাক্কা খেলেন। মনে হল দরজা ভেঙ্গে পড়ে যাচ্ছে। ওসি সাহেব মহা বিরক্ত হয়ে বললেন, এই ইডিয়ট কে?
আমি ওসি সাহেবের সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বললাম, উনি এই মেসের ম্যানেজার সরফরাজ আলি খাঁ। খুব উচ্চ বংশ এবং খাঁটি দেশপ্রেমিক। দেশ নিয়ে উনি সর্বক্ষণ চিন্তা ভাবনা করছেন। গবেষণা করছেন। সোনার বাংলা কেন শাশান হচ্ছে আপনি যদি উনাকে জিজ্ঞেস করেন। উনি খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দেবেন।