ড্রাইভারা
জ্বি।
তেল ছাড়া শুধু ফুঁয়ের উপর গাড়ি কেমন চলছে দেখেছ?
রিজার্ভে সামান্য তেল ছিল তাই দিয়ে চলেছে। আর চলবে না।
চলবে না মানে? আবারো ফুঁ দিয়ে দেব। — আবারো চলবে, ময়মনসিংহ থেকে ঘুরে আসতে পারব।
ময়মনসিংহ যাবেন?
জ্বি।
ময়মনসিংহে কি?
কিছু না। আমার ফুঁয়ের জোর পরীক্ষা করা।
ড্রাইভার গম্ভীর হয়ে গেল। আমি খুঁজে খুজে ব্যাঙাচির বাড়ি বের করলাম। ছোট একতলা বাড়ি। গাছপালায় ভর্তি। আমি পাজেরো ড্রাইভারকে বললাম, বেশিক্ষণ না। আমি ঘন্টা খানিক থাকব। — তারপর ময়মনসিংহ। তুমি অপেক্ষা কর। আমার সঙ্গে টাকা পয়সা থাকে না, কাজেই চা খাওয়ার টাকা দিতে পারছি না। পেট্রল বেচে চা নাশতা করতে পার। সমস্যা নেই।
ব্যাঙচি বাসায় ছিল না। তার স্ত্রী খুবই কৌতূহলী হয়ে আমাকে কিছুক্ষণ দেখলেন। তারপর সহজ গলায় বললেন, ভেতরে এসে বসুন। ও এসে পড়বে।
ভদ্রমহিলা অসম্ভব রোগা। তাঁর চোখ জ্বল জ্বল করছে কিংবা চশমার কাচ জ্বল জ্বল করছে। প্রফেসর প্রফেসর চেহারা। বয়সকালে রূপবতী ছিলেন। সেই রূপ পুরোপুরি চলে যায়নি। ভদ্রমহিলার গলার স্বর খুবই কোমল। তিনি বললেন, আপনার নাম হিমু?
জ্বি।
ও আপনার কথা আমাকে বলেছে। আপনি নাকি ওর স্কুল জীবনের বন্ধু। ওর কোন বন্ধু-বান্ধব বাসায় আসে না। আপনাকে দেখে সেই জন্যেই খুব অবাক হয়েছি। দাঁড়িয়ে আছেন কেন, বসুন।
আমি বসলাম। ভদ্রমহিলা বললেন, চা দিতে বলি? চায়ে চিনি দুধ খান তো?
জি খাই। ভদ্রমহিলা ভেতরে চলে গেলেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ঢুকলেন। আমার জীবনে কোন বাড়িতে এত দ্রুত কাউকে চা দিতে দেখিনি।
ভদ্রমহিলা হাসি মুখে বললেন, আমার ঘন ঘন চা খাবার অভ্যাস। ফ্লাক্স ভর্তি করে। চা বানিয়ে রাখি। সেখান থেকেই আপনাকে দিলাম।
থ্যাংক য়ু।
কিছু মনে করবেন না। আপনাকে শুধু চা দিতে হল। ঘরে কোন খাবার নেই। ইচ্ছা করেই খাবার রাখি না। খাবার যেখানেই থাকুক ও খুঁজে বের করে খেয়ে ফেলে।
আমি কিছু বললাম না। চায়ে চুমুক দিলাম। ফ্লাক্সে রাখা চা কখনো খেতে ভাল হয়। না। এই চাটা ভাল হয়েছে।
আপনার বন্ধুর খাই খাই স্বভাবের সঙ্গে তো আপনার পরিচয় আছে। আছে না।
জ্বি আছে।
ও সবকিছু খেতে পারে। একবার বড় গ্লাসে এক গ্লাস সোয়াবিন তেল নিয়ে লবণ মিশিয়ে খেয়ে ফেলেছিল। ও হচ্ছে বিংশ শতাব্দীর কুম্ভকৰ্ণ। কুম্ভকৰ্ণ কে তা জানেন?
জ্বি না।
কুম্ভকৰ্ণ হল রাবণের মেঝো ভাই। তার মার নাম কৈকেয়ী। কুম্ভকর্ণের ক্ষুধা কখনো মিটতো না। এমন জিনিস নেই যে সে খেত না। সাধু সন্ন্যাসী, ঋষি সবই খেয়ে ফেলতো।
ও আচ্ছা।
তার যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে ব্ৰহ্মা তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। সে ছয় মাস ঘুমাত। তারপর একদিন জগত। আবার ছমাসের জন্যে ঘুমিয়ে পড়ত। এই জন্যেই তার নাম কুম্ভকৰ্ণ। আপনার বন্ধুকে যদি এইভাবে ঘুম পাড়িয়ে রাখা যেত আমি বেঁচে যেতাম।
ভদ্রমহিলা কথা বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালেন। আবার বসে পড়লেন। হাতের ঘড়ি দেখলেন। দরজার দিকে তাকালেন। স্বামী এখনো ফিরছে না। এটাই বোধ — হয় অস্থিরতার কারণ।
হিমু সাহেব।
জ্বি।
ও এসে পড়বে। মিষ্টি পান আনতে গেছে। কাজের ছেলেটা গেছে ছুটিতে, বাধ্য হয়ে ওকেই পাঠাতে হয়েছে। এত দেরি কেন হচ্ছে বুঝতে পারছি না। কোন রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়ছে কিনা কে জানে।
আমি কি আশপাশে খুঁজে আসব?
দরকার নেই। আপনি কোথায় খুঁজবেন। তারপর বলুন কেমন আছেন?
জ্বি ভাল আছি।
আরেক কাপ চা খাবেন!
জ্বি না।
ওরা রোগটা কিভাবে হয় সেটা কি আপনি জানেন।
জ্বি না।
আমার সঙ্গে বিয়ের পরপর সে জার্মানী চলে যায় অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং শিখতে। আমার জন্যে তখন তার খুব মন খারাপ থাকতো। কিছু ভাল লাগত না। শুধু যখন রেস্টুরেন্টে খেতে যেত তখন আমার কথা ভুলতে পারত। আমাকে ভোলার জন্যে খাওয়া ধরেছে। সেই খাওয়াই কাল হয়েছে।
ভালবাসার মনে ক্ষুধার যোগ আছে।
প্রেমিক-প্রেমিকাকে সব সময় দেখবেন কিছু না কিছু খাচ্ছে। এই চটপটি, এই আইসক্রিম, এই বাদাম, এই ফুচকা।
ও বলছিল। আপনি নাকি তার চিকিৎসা করছেন। কি ধরনের চিকিৎসা বলুন তো?
আমি হকচকিয়ে গেলাম। বাঙাচি আমাকে তার চিকিৎসক হিসেবে উপস্থিত করেছে কেন বুঝতে পারছি না। আমাকে সে এই প্রসঙ্গে কিছু বলেনি।
ভদ্রমহিলা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, কোন চিকিৎসায় ওর কিছু হবে না। চিকিৎসা কম করানো হয়নি। সাইকিয়াটিষ্ট দেখানো হয়েছে। ব্যাংকক নিয়ে পেট থেকে এক বালতি চর্বি বের করে ফেলা হয়েছে। অকুপাংচার করানো হয়েছে। একবার একজন বলল যারা সারাক্ষণ খাই খাই করে গাজা খেলে তাদের ক্ষুধা কমে। আমি নিজে গাঁজা কিনে সিগারেটে ভরে তাকে খাইয়েছি। কিছু হয়নি। মানুষটা একদিন খেতে খেতে মারা যাবে। কি কুৎসিত ব্যাপার চিন্তা করে দেখুন তো।
ঠিক হয়ে যাবে।
কোনদিনও ঠিক হবে না। ওর যখন খুব ক্ষিধে পায় তখন ওর চোখের দিকে তাকবেন। আপনার মনে হবে ও আপনাকে রান্না করে খেয়ে ফেলার কথা মনে মনে ভাবছে। আপনি কি দুটা মিনিট বসবেন, আমি একটা জরুরী টেলিফোন করে আসি।
আমি বসছি। আপনি টেলিফোন করে আসুন। কাজকর্ম সারুন। আমাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।
আমি প্ৰায় এক ঘন্টার মত বসে রইলাম। ভদ্রমহিলা এক সময় বললেন, ভাই, কিছু মনে করবেন না, আপনি কি একটু খুঁজে দেখবেন? আশপাশের রেস্টুরেন্টগুলিতে গেলেই হবে। ও কোন একটা রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়া-দাওয়া করছে।