হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, কেমন আছিস হিমু?
ভাল।
আরো আগে চলে আসতাম, বুলবুল পাথরটার কথা বলল। ভাবলাম ঠিক আছে দেখেই যাই। পাথর দেখে এসেছি।
হাত দিয়ে ছুঁয়েছ?
হুঁ। হিমু তুই বললে বিশ্বাস করবি না— হাত দিয়ে ছোঁয়ামাত্র ইলেকট্রিক শকের মত শক খেলাম। মনে হল পাথরটা জীবন্ত। আমার গায়ের সব লোম খাড়া হয়ে গেল।
আমি তামান্নার দিকে তাকালাম। তামান্না আমার দৃষ্টি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে কিশোরীদের মত ছটফট গলায় বলল, ম্যাডাম, আপনি একা গিয়ে দেখে এলেন। আমাকে নিলেন না। আমিও পাথরটা ছুঁয়ে দেখতাম।
ফাতেমা খালা বললেন, পাথর গিয়ে দেখার দরকার নেই। পাথরটা আমি কিনব। যত টাকা লাগে। কিনব। গাড়িতে আসতে আসতে মন স্থির করেছি। হিমু, তোর উপর দায়িত্ব হচ্ছে পাথরটা কেনার ব্যবস্থা করা। তোকে আমি তার জন্যে আলাদা কমিশন দেব। কেনার ব্যবস্থা করতে পারবি না?
পারব।
বুলবুল বলছিল তুই নাকি এই পাথরটার বিষয়ে জনিস। পাথরটার ক্ষমতা কি বল দেখি।
খালা এটা হল ইচ্ছাপূরণ পাথর। পাথরে হাত দিয়ে যা চাইবে তাই পাবে।
সত্যি বলছিস, না ঠাট্টা করছিস।
সত্যি বলছি।
তোর মুখ দেখে মনে হচ্ছে তুই ঠাট্টা করছিস। ঠাট্টা করলেও কিছু যায় আসে না— পাথরটা আমার দরকার। তুই এক কাজ কর এক্ষুনি যা পাথরটা নিয়ে আয়। পাজেরো গাড়িটা নিয়ে যা— মালিক শুদ্ধ নিয়ে আসবি। পাথরের দাম যা ঠিক হয়। আমি দিয়ে দেব।
ইয়াকুব সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়েছে। আমি এক কাজ করি, গাড়ি করে না হয়। ইয়াকুব সাহেবকে নিয়ে আসি। পাথর আরেকদিন আনিব।
ইয়াকুব পালিয়ে যাচ্ছে না। তুই পাথর আগে নিয়ে আয়। পাথরের সত্যি সত্যি ক্ষমতা আছে কিনা সেটা আজ রাতেই টেস্ট করব।
আমি আড়চোখে তামান্নার দিকে তাকালাম। তার ঠোঁটের কোণায় মোনালিসা ষ্টাইল হাসি।
খালা তামান্নাকে বললেন, তামান্না তুমি একটু এই ঘর থেকে যাও। আমি হিমুকে কিছু পার্সেনাল কথা বলব।
তামান্না চলে গেল। খালা গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললেন, মেয়েটাকে ইচ্ছা করে রেখে গিয়েছিলাম যাতে দুজনের মধ্যে পরিচয়টা গাঢ় হয়। মেয়েটাকে কেমন লাগছে?
খুব ভাল।
কি রকম সরল মেয়ে দেখেছিস? জগতের কোন জটিলতা এই মেয়ে ধরতে পারে। না। আর আমাকে যে কি পছন্দ করে। আমার নিজের কোন মেয়ে থাকলে সেও আমাকে এত পছন্দ করত না। এই যে আমি তাকে ছাড়া পাথর দেখে এসেছি তার জন্যে সে কেমন মন খারাপ করে দেখেছিস? আর একটু হলে কেঁদে ফেলত। তাই না?
হ্যাঁ।
চোখ ছিল ছল করছিল। কিনা তুই বল।
ছল ছল মানে আরেকটু হলেই টপটপান্তি পানি পড়া শুরু হত।
আমি যদি এখন তাকে বলি, তামান্না আমি চাই তুমি হিমুকে বিয়ে কর সে কোনদিকে তাকাবে না, তুই যে একটা প্রথম শ্রেণীর ভ্যাগাবল্ড, চাকরি বাকরি নেই, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াস। এইসব নিয়েও ভাববে না। চোখ বন্ধ করে বিয়ে করবে।
তাহলে বলে ফেল। ফেলাছ না কেন? ধর তক্তা মার পেরেক ঝামেলা শেষ করে।
আমি বলব না। আমি চাই মেয়েটা যেন নিজ থেকে তোর প্রতি আকৃষ্ট হয়। সে নিজেই যদি তোকে পছন্দ করে ফেলে তাহলে আর আমাকে পরে দোষ দিতে পারবে না। আমি অবশ্যি তামান্নার ব্রেইন ওয়াস করে ফেলেছি–তোর সবক্ষেত্রে তোর সম্পর্কে বানিয়ে বানিয়ে অনেক মিথ্যা কথা বলি।
খালা মেনি থ্যাংকস।
তুই একটা কাজ করবি, মেয়েটাকে নিয়ে ভাল কোন রেস্টুরেন্টে খেতে যাবি। আমি খরচা দেব। মেয়েরা রেস্টুরেন্টে খেতে পছন্দ করে।
ভাল কোন রেক্টরেন্টে তো খালি পায়ে আমাকে ঢুকতেই দেবে না।
গাধার মত কথা বলিস না তো, তোকে স্যান্ডেল, পাঞ্জাবী। এইসব কিনে দিয়েছি না। ফিটফাট হয়ে যাবি। আরেকটা কথা, রেস্টুরেন্টের বয় বাবুর্টির সঙ্গে রসিকতা করবি না। লোয়ার লেভেলের লোকজনদের সঙ্গে রসিকতা মেয়েরা একদম পছন্দ করে না।
কোথায় পড়েছ রিডার্স ডাইজেষ্টে?
মনে নেই কোথায় পড়েছি। তুই এক কাজ কর –আগামীকালই যা। গুলশানে একটা রেস্টুরেন্ট আছে। তন্দুরী খুব ভাল করে। আমার কাছে ওদের কার্ড আছে, তোকে দিচ্ছি। একটু বোস কার্ডটা নিয়ে আসি।
কার্ডটা কাল নেই।
কাল ভুলে যাব। আজই নিয়ে যা।
আমি তন্দুর হাউসের কার্ড এবং পাজেরো গাড়ি নিয়ে বের হলাম। ভিক্ষুক মেছকান্দর সাহেবকে পাওয়া গেল না। পাজেরো ডাইভারকে বললাম, চলুন শহরে ঘুরে বেড়াই। ভিক্ষুক খুঁজে বেড়াই।
পাজেরো ড্রাইভার খুবই বিরক্ত হল। পুরো দুঘন্টা শহরে ঘুরলাম। তারপর গেলাম শহরের বাইরে। সাভার স্মৃতিসৌধ দেখে এলাম। স্মৃতিসৌধ দেখা হবার পর ড্রাইভার বলল, আর কোথায় যাবেন?
আমি বললাম, জাপান বাংলাদেশ মৈত্রী সেতুতে চল। সেতুটা দেখা হয়নি।
গাড়িতে তেল নেই। তেল নিতে হবে। ফুয়েলের কাটা মাঝামাঝি জায়গায় আছে, সে বলছে তেল নেই। আমি মধুর গলায় বললাম, তেল ছাড়াই গাড়ি চলবে। আমি সাধু মানুষ, মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিয়ে দিচ্ছি। বিনা তেলেই গাড়ি চলবে। তুমি তেল বিষয়ক কোন চিন্তাই মাথায় স্থান দিও না।
আপনি সত্যি সত্যি জাপান-বাংলাদেশ সেতু দেখতে যাবেন?
অবশ্যই। পাকিস্তান-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু থাকলে ভাল হত। সেটাও দেখে আসতাম। নাই যখন জাপান-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতুই সই।
চলেন।
আমি চোখ বন্ধ করে গম্ভীর ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ বিড় বিড় করে গাড়ির ডেসবোর্ডে দুটা ফুঁ দিয়ে দিলাম। ড্রাইভারের নিশ্চয়ই পিত্তি জ্বলে গেল।
জাপান-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু দেখে ফিরতে ফিরতে রাত দশটা বেজে গেল। গাড়ি যখন সঙ্গে আছে ব্যাঙাচির বাসা খুজে বের করলে কেমন হয়। ড্রাইভারকে বললাম বাসবোর দিকে যেতে। জীপের ড্রাইভার ভয়ংকর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাচ্ছে। তার পাশের সীটে বসে না থেকে আমি যদি রাস্তায় থাকতাম। সে নির্ঘাৎ আমাকে চাপা দিত।