হিমু সাহেব?
জ্বি।
পাথরটা হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিলে আমি চারশ ভল্টের শক খাব?
চারশ ভোল্টের শক খাবেন না— মৃদু ধাক্কার মত লাগবে।
আপনি আমাকে নিয়েও রহস্য তৈরি করবেন না। প্লীজ। সরবত খাচ্ছেন–খান। আমি খুব দুঃখকষ্টে মানুষ হয়েছি। যারা দুঃখকষ্টে মানুষ হয় তারা এত সহজে বিভ্রান্ত হয় না। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে মানুষ হিসেবে আমি কখনো বোকা ছিলাম না।
আমি সরবরতের গ্লাসে লম্বা চুমুক দিয়ে বললাম, ফাতেমা খালার ফিরতে মনে হয় দেরি হবে। আমি উঠি?
তামান্না কঠিন গলায় বলল, না। আপনি উঠবেন না। ম্যাডাম আমাকে বলে গেছেন আপনি যদি আসেন। আপনাকে যেন আটকে রাখা হয়। লাইব্রেরী ঘরে গিয়ে বসতে পারেন— বইটই পড়লে সময় কাটবে।
ঘরে নিয়ে বসাতে। আমার ধারণা তিনি আপনাকে বলে গেছেন আমার সঙ্গে গল্প-গুজব করতে। তাই না!
হ্যাঁ তাই। বেশ আপনি গল্প করুন, আমি শুনছি।
রূপকথা শুনবেন?
যা শুনাবেন তাই শুনব।
আমি বেশ কায়দা করে গল্প শুরু করলাম। যে কোন কারণেই হোক তামান্না মেয়েটি আমার উপর অসম্ভব বিরক্ত। বিরক্তিটা এই পর্যায়ে যে সে আমার দিকে তাকাতেও পারছে না। সে গল্প শুনছে খুবই অনাগ্রহ এবং অনিচ্ছায়।
তিন জেলে গিয়েছে মাছ মারতে। সাগরে জাল ফেলেছে। জালে ধরা পড়ল এক মৎস্যকন্যা, মারমেইড। মৎস্য কন্যা বলল, তোমাদের আল্লাহর দোহাই লাগে তোমরা আমাকে মের না। আমাকে সাগরে ফেলে দাও, তার বদলে তোমাদের প্রত্যেকের একটা করে ইচ্ছা আমি পূর্ণ করব। তবে আমি তো আর আলাদীনের জ্বিনের মত ক্ষমতাবান না— আমার ক্ষমতা সীমিত। আমি টাকা পয়সা। ধনদৌলত দিতে পারব না।
প্রথম জেলে বলল, আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি আমার বুদ্ধি বাড়িয়ে দাও। এখন যে বুদ্ধি আমার আছে তা ডাবল করে দাও।
মৎস্য কন্যা বলল, ডাবল করা হল।
প্রথম জেলে সঙ্গে সঙ্গে বুঝল তার বুদ্ধি বেড়েছে।
দ্বিতীয় জেলে বলল, একজন যখন বুদ্ধি নিয়েছে তখন আমিও বুদ্ধিই নেব। তবে ডাবল না। আমার বুদ্ধি তিনগুণ করে দাও। মৎস্য কন্যা বলল, তিনগুণ করা হল।
তৃতীয় জেলে বলল, আমিও বুদ্ধই চাই। তবে চাই দশগুণ।
মৎস্যকন্যা বলল, খবৰ্দার, এইটি করবে না। দশগুণ বুদ্ধি তোমাকে দেয়া হলে তুমি বিপদে পড়বে।
বিপদে পড়া না পড়া আমার ব্যাপার। তোমার কাছে দশগুণ বুদ্ধি চেয়েছি, তুমি বুদ্ধি দাও।
এখনো সময় আছে ভেবে দেখা।
ভাবাভাবির কিছু নাই।
মৎস্যকন্যা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, আচ্ছা যাও, তোমাকে দশগুণ বুদ্ধি দেয়া হল। আর সঙ্গে সঙ্গে তৃতীয় জেলে একটা মেয়ে হয়ে গেল।
তামান্না বলল, আপনি বলতে চাচ্ছেন যে মেয়েদের বুদ্ধি পুরুষদের চেয়ে দশগুণ বেশি?
হ্যাঁ।
এই গল্পটা কি আপনি আমাকে খুশি করার জন্যে বললেন?
আপনাকে খুশি করার একটা প্রচ্ছন্ন ইচ্ছা আমার ছিল। তবে গল্পটা আমি বিশ্বাস করি।
তামান্না নড়ে চড়ে বসল। এবং আমাকে হঠাৎ খুবই বিস্মিত করে দিয়ে বলল, হিমু। সাহেব, শুনুন। ম্যাডাম চলে আসার আগে আপনাকে খুব জরুরী কিছু কথা বলি, দয়া করে মন দিয়ে শুনুন। আপনার বুদ্ধিও মেয়েদের মতই দশগুণ বেশি। তবে এই বুদ্ধিতে কাজ হবে না। আমি আপনাকে পছন্দ করি না। আমি যাদেরকে পছন্দ করি না তাদের সে ব্যাপারটা বুঝতে দেই না। বরং এমন ভাব করি যাতে তারা বিভ্রান্ত হন। তারা মনে করেন। আমি তাদের খুবই পছন্দ করি। আপনার বেলায় ব্যতিক্রম করলাম। আমি যে আপনাকে অপছন্দ করি সেটা জানিয়ে দিলাম।
কেন?
অ্যাপনার সঙ্গে অস্পষ্টতা রাখলাম না।
আপনি আপনার ম্যাডামকে খুবই অপছন্দ করেন তাই না?
হ্যাঁ উনাকে অপছন্দ করি। বোকা মানুষ আমার পছন্দ না। আপনার খালা মেয়ে হয়েও বোকা। মৎস্যকন্যার গল্প আপনার খালার ক্ষেত্রে কাজ করছে না। যে কারণে আমার অপছন্দের ব্যাপারটা উনাকে জানতে দেইনি। কারণ উনার সাহায্য আমার দরকার। আমি বিশাল সংসার নিয়ে বিপদে পড়ে গেছি।
তামান্না বেশ সহজ এবং স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আমার সামনে বসে আছে। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছি। মনে হচ্ছে আমাদের সামনে অদৃশ্য একটা দাবার সেট। দাবা খেলা হচ্ছে। আমি তাকে কিস্তি দিয়ে দিলাম। কিস্তি কাটান দিয়ে সে উল্টো কিস্তি দিয়েছে। ঘোড়ার কিস্তি। এক সঙ্গে রাজা এবং মন্ত্রী ধরা পড়েছে। রাজা বাঁচাতে হলে আমাকে মন্ত্রী বিসর্জন দিতে হবে। রাজা না বাঁচিয়ে মন্ত্রী বাঁচালে কেমন হয়। খেলা শেষ হয়ে যায়। তাতে কি, মন্ত্রীর মত শক্তিশালী ঘুটি তো বেঁচে রইল। আমি রাজা বিসর্জন দেবার ব্যবস্থা করলাম। কোমল গলায় বললাম, তামান্না, আপনি বোধহয় জানেন না, আমি আপনাকে খুবই পছন্দ করি। আপনার মত পছন্দ এই জীবনে আরেকটি মেয়েকে করেছিলাম তার নাম রূপা।
তামান্না আমার কথায় মোটেই চমকাল না। সে কঠিন মুখে বলল, প্লীজ আপনি মিথ্যা কথা বলবেন না। আপনি এই দীর্ঘ জীবনে কাউকে পছন্দ করেননি। ভবিষ্যতেও কাউকে পছন্দ করবেন বলে মনে হয় না। পৃথিবীতে কিছু কিছু খুব দুর্ভাগা মানুষ জন্মগ্রহণ করে। তারা কাউকে ভালবাসতে পারে না। আপনি সেই সব দুর্ভাগা মানুষদের একজন ৷
আমি বললাম, ও আচ্ছা।
আপনি মহাপুরুষ সেজে পথে পথে হাটেন—সেটাই আপনার জন্যে ভাল।
আমি আবারো বললাম, ও আচ্ছা।
তামান্না দীর্ঘ কোন বক্তৃতার জন্যে তৈরি হচ্ছিল — নিজেকে সামলে নিল কারণ ফাতেমা খালা এসে পড়েছেন। তাঁকে খুবই উত্তেজিত মনে হচ্ছে।