ইয়াকুব সাহেব এক হাতে মুড়ির বাটি এবং হারিকেন অন্য হাতে কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে ঢুকলেন।
ইলেকট্রিসিটি আজ বোধহয় আসবেই না। নিন, মুড়ি খান। খেয়ে অবশ্যি আরাম পাবেন না— মুড়ি ন্যাতনাতা হয়ে গেছে। টিন ভাল করে বন্ধ করেনি। বাতাস ঢুকে মুড়ি মরা মরা হয়ে গেছে।
তিনবার ফুঁ দিলেন, মুড়ি তাজা হয়ে গেল।
ভদ্রলোক দুঃখিত চোখে তাকিয়ে রইলেন। আমি মুড়ি চাবাতে চাবাতে বললাম, ঠাট্টা করছিলাম।
ইয়াকুব সাহেব শীতল গলায় বললেন, মন্ত্র বিশ্বাস করা-না-করা আপনার ইচ্ছা। কিন্তু মন্ত্র নিয়ে ঠাট্টা করবেন না। মন্ত্র হল বিচিত্র ধ্বনির কিছু শব্দ। শব্দ তুচ্ছ করার বিষয় নয়। আদিতে কিছুই ছিল না। আদিতে ছিল মহাশূন্য। তারপর একটা শব্দ হল— বিগ বেং। তৈরি হল বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড। কাজেই সৃষ্টির মূলে আছে শব্দ।
আমি বললাম, আপনার কাপড়ের ব্যাগে কি?
আপনাকে একটা জিনিস দেখাবার জন্যে এনেছিলাম –মানুষের একটা কঙ্কাল, নরমুণ্ড।
দেখান।
আপনি অবিশ্বাসী টাইপ মানুষ। আপনাকে দেখানো না-দেখানো সমান। সত্যিকার কোন জহুরীর হাতে পড়লে সে লাফিয়ে উঠত।
বিশেষ ধরনের নরমুণ্ডু?
খুব লক্ষ্য করে দেখুন, আপনার কাছে বিশেষ ধরনের মনে হয়, নাকি সাধারণ মনে হয়।
আমি বিশেষ কিছু দেখলাম না। সাইজে ছোট একটা নরমুণ্ডু। স্কাল সাদা থাকে। এটা একটু কালচে হয়ে আছে–মনে হয় অনেকদিনের পুরানো।
বিশেষ কিছু বুঝতে পারছেন না?
জ্বি না।
অক্ষিকোটরা দুটা থাকে–এর যে তিনটা সেটা বুঝছেন?
আমি দেখলাম কপালেও একটা ফুটো। সেই ফুটাকে অক্ষিকেটের মনে করার কারণ নেই। হয়ত অন্য কোন কারণে ফুটো হয়েছে। কপালে গুলি খেলে কপাল ফুটো হবার কথা।
আপনি বলতে চাচ্ছেন জীবিত অবস্থায় এই মানুষটার তিনটা চোখ ছিল?
ইয়াকুব সাহেব নরমুণ্ডু থলিতে ভরতে ভরতে বললেন, সব মানুষেরই তিনটা চোখ থাকে। দুটা দৃশ্যমান, একটা অদৃশ্য।
ও আচ্ছা।
ইলেকট্রিসিটি চলে এসেছে। আমি বললাম, ইয়াকুব সাহেব, আমি উঠি।
ইয়াকুব সাহেব আমাকে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। অতি বিনীত ভঙ্গিতে বললেন, একদিন এসে আমার সাথে চারটা খানা খান। দরিদ্র মানুষ বেশি কিছু খাওয়াতে পারব না। মটরশুটি দিয়ে শিং মাছের ঝোল আর ভাত। কবে খাবেন বলুন।
আগামী সপ্তাহে আসি?
জ্বি আচ্ছা, আসুন। আপনার মোটা বন্ধুকেও নিয়ে আসবেন। উনার জন্যে একটা অষুধ বানিয়ে রাখব। খেলে ক্ষুধা কমে যাবে। অতি সুখাদ্যেও অরুচি হবে।
টেবলেট জাতীয় কিছু??
জ্বি। ফার্মেসীর ট্যাবলেট না— বড়ি জাতীয়। সকাল-বিকাল দু বেলা সেব্য।
বড়ি খেলে ক্ষিধে লাগবে না।
জ্বি না।
এই ক্ষুধা মুক্তি ট্যাবলেট তো সারা বাংলাদেশের মানুষের জন্যে দরকার। তৈরি আছে? থাকলে দুটা দিন নিয়ে যাই— ট্রাই করে দেখি।
জ্বি না, তৈরি নেই।
তৈরি করে রাখুন। টেবলেটটির নাম কি?
কোন নাম দেইনি।
নাম দিন ইয়াকুবের ক্ষুধামুক্তি বড়ি।
আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না। তাই না?
আমি জবাব না দিয়ে হাঁটা ধরলাম। ফাতেমা খালা সিঙ্গাপুর থেকে ফিরেছেন। কিনা খবর নেয়া দরকার।
খালা বাড়িতে নেই। তিনি তাঁর আর্কিটেক্টের কাছে গিয়েছেন। বাড়িতে যে সোয়ানা বসবে তার ডিজাইন নিয়ে কথা বলবেন। পুরানো ডিজাইন তাঁর পছন্দ হচ্ছে না। ফলস সিলিং অনেক উঁচুতে হয়েছে। আরো নিচু হওয়া দরকার। সোয়ানার ঘরে দমবন্ধ দমবন্ধ ভাবটা আসল। তামান্না আমাকে বসতে দিল। তার আচার-আচরণ স্বাভাবিক। মনে হচ্ছে আজই তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। আমি চাইবার আগেই লম্বা গ্লাস ভর্তি সবুজ রঙের কি এক সরবত এনে দিল। সরবতের গ্লাসে বরফের কণা ভাসছে। আমি চুমুক দিতে দিতে বললাম, জামান ভাল আছে?
তামান্না বিস্মিত হয়ে বলল, জামান কে?
আপনার ছোট ভাই রিকশা থেকে পড়ে যে ব্যথা পেয়েছিল।
ও আচ্ছা। হ্যাঁ, জামান ভাল আছে। তার রিকশা থেকে পড়ে ব্যথা পাওয়ার কথা
আপনাকে কে বলেছে?
আপনার ম্যাডাম বলেছেন।
যে আপনাকে যা বলে তাই আপনি মনের ভেতর ঢুকিয়ে রেখে দেন?
সবাই তাই করে।
সবাই তাই করে না। আপনি অন্য সবার মত না।
আমি আলাদা?
হ্যাঁ আলাদা, তবে ভাল অর্থে আলাদা না, মন্দ অর্থে আলাদা। আপনার সমস্ত জীবন এবং কর্মকান্ড জুড়ে আছে ভান। মিথ্যা রহস্যের ধোঁয়া সৃষ্টি করে আপনি তার মধ্যে বাস করতে ভালবাসেন। কুড়ি হাজার টাকা দিয়ে আপনি পাথর কিনতে গিয়েছিলেন। যাননি?
হ্যাঁ।
যার পাথর সে বিক্রি করল না, কারণ আপনি এমনই এক রহস্যের কুয়াশা তার সামনে তৈরি করলেন যে সে ভাবল না জানি এটা কি পাথর। কাজটা আপনি করলেন ম্যানেজার সাহেবের সামনে কারণ আপনি একই সঙ্গে তা ভড়কে দিতে চেয়েছেন— তাই না?
হ্যাঁ। উনি কি ভড়কেছেন?
যথেষ্ট ভড়কেছেন। গতকাল অনেকক্ষণ তিনি আমার সঙ্গে বুলিবুলি করেছেন। পাথরটা দেখে আসার জন্যে।
আপনি কি দেখে এসেছেন?
হ্যাঁ।
আমি আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘পাথরটা হাত দিয়ে ছুঁয়েছেন?
হাত দিয়ে ছোঁব কেন?
হাত দিয়ে ছুঁলেই একটা ইন্টারেষ্টিং ব্যাপার হত। ইলেকট্রিক শকের মত একটা শক খেতেন। নেক্সট টাইম যখন যাবেন হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখবেন।
তামান্না একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আরাম করে সরবত খাচ্ছি। সরবতে কেমন লজেন্স লজেন্স গন্ধ। অতিরিক্ত মিষ্টি। অতিরিক্ত মিষ্টিটা মনে হয় এই সরবতের জন্যে প্রয়োজন। মিষ্টি কম হলে ভাল লাগত না।