তিনি নিচু গলায় বললেন, ভাল।
খাওয়া-দাওয়া হয়েছে?
হুঁ।
তাহলে শুধু শুধু বসে আছেন কেন, চলে যান।
তোমার খালার জন্যে বসে আছি। একটু দেখবে –ও যাবে কিনা। মনে হয় না। বিয়েবাড়ির মজা ফেলে যাবে।
আমি খালাকে খুঁজে বের করলাম। তিনি হতভম্ব গলায় বললেন, পাগল! আমি এখনি যাব কি? খাওয়া-দাওয়ার পর গান-বাজনা হবে। গান শুনব না? তুই তোর খালুকে চলে যেতে বল। গাড়িটা যেন রেখে যায়। হিমু শোন, তুই একটা উপকার কারবি? তোর খালুর সঙ্গে বাসায় চলে যা। আমার অটোগ্রাফের খাতাটা নিয়ে আয়।
খাতা ফেলে এসেছ?
হুঁ। মাঝে মাঝে এমন বোকামি করি যে ইচ্ছা করে নিজেকেই নিজে চড় মারি। চড় মেরে চাপার দাঁত ফেলে দেই।
বিয়েবাড়িতে বিখ্যাত কেউ এসেছে?
তুই কি গাধা নাকি? দেখতে পাচ্ছিস না— জুয়েল আইচ সাহেব এসেছেন, উনার স্ত্রী বিপাশা আইচ এসেছেন। এরা কতক্ষণ থাকবেন কে জানে। তুই চট করে। অটোগ্রাফের খাতা নিয়ে আয়। আমার ডেসিং টেবিলের উপর আছে। শুধু খাতা না, কলামও আনবি।
আমি খালু সাহেবের সঙ্গে বাসায় গেলাম। ডেসিং টেবিলের উপর থেকে ফাতেমা খালার অটোগ্রাফের খাতা উদ্ধার করলাম। খালু সাহেব গুণে গুণে সাত টাকা দিয়ে দিলেন ফেরার রিকশা ভাড়া। আমাকে বললেন, রিকশাওয়ালা আট টাকা চাইবে। দরাদরি করলে সাত টাকায় রাজি হবে।
আমি কিছুক্ষণ বিস্মিত হয়ে খালুর দিকে তাকিয়ে বললাম, আচ্ছা। পরদিন খালু সাহেবকে আমি চার টাকা ফেরত দিয়ে বললাম, শেয়ারে রিকশা পেয়ে চলে গেছি। তিন টাকা নিয়েছে। আপনার চার টাকা বাঁচিয়ে দিলাম।
তিনি হাসতে হাসতে বললেন, ঐদিন গুণে গুণে সাত টাকা দিয়েছি বলে রাগ করেছ?
আমি বললাম, না, রাগ করব কেন?
মনে হয় রাগ করেছি। রাগ না করলে এই চার টাকা ফেরত দিতে আসতে না। যাই হোক, তুমি কিছু মনে করো না। হিসেব করে করে এই অবস্থা হয়েছে। সারাক্ষণ হিসেব করি। গাড়িতে যখন তেল ভরি তখন হিসেব করি কতটুকু তেল নিলাম। গাড়ি কতক্ষণ চলবে। এর আগে কবে তেল নিয়েছি। বুঝলে হিমু, আমি শান্তিমত পাঁচটা টাকাও খরচ করতে পারি না। ঐদিন কি হয়েছে শোন। — গাড়ি করে যাচ্ছি মতিঝিল। শেরাটনের কাছে রেড লাইটে গাড়ি থেমেছে। — ফুল বিক্রি করে একটা মেয়ে এসে ঘ্যানঘান শুরু করল, ফুল নেন। ফুল নেন। আমি মুখ শক্ত করে বসে আছি। হঠাৎ দেখি আমার ড্রাইভার তার পকেট থেকে ফস করে একটা দশ টাকার নোট বের করে মেয়েটাকে দিয়ে দিল। আমি হতভম্ব।
ড্রাইভারের কাণ্ড দেখে খুশি হলেন?
না। আমার মাথায় ঢুকে গেল, ড্রাইভার কি পয়সা মারছে? তেল চুরি করছে? নতুন টায়ার বিক্রি করে পুরান টায়ার লাগিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে? তা না করলে ফুলওয়ালীকে ফস করে দশ টাকার নোট দেয় কি করে?
আপনি ড্রাইভার ছাঁটাই করে দিলেন?
ঠিক ধরেছ। নতুন ড্রাইভার নিলাম। আমি অবশ্যি এমিতেই এক ড্রাইভার বেশিদিন রাখি না। চার মাসের বেশি কাউকেই রাখি না। ডাইভাররা শুরুতেই চুরি শুরু করে না। একটু সময় নেয়। আমি সেই সময় পর্যন্ত তাদের রাখি। তারপর বিদায়। সবই হচ্ছে আমার হিসেবা। আমি বাস করি কঠিন হিসেবের জগতে।
তার জন্যে কি আপনার মন খারাপ হয়?
না, মন খারাপ হয় না। আমাকে তৈরিই করা হয়েছে। এইভাবে — মন খারাপ হবে। কেন? সাধু সন্ত মানুষ কি মন খারাপ করে –কেন তারা সাধু প্ৰকৃতির হল? না করে না। কারণ তাদের মানসিক গড়নটাই এমন। আমার বেলাতেও তাই। এই যে তুমি হিমু। সেজে পথে পথে ঘুরে বেড়াও — তোমার কি মন খারাপ হয়?
না।
কফি খাবে?
কফিও নিশ্চয়ই আপনার হিসেব করা। আমি খেলে কম পড়বে না?
না, কম পড়বে না, খাও। কফি খেতে খেতে তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করি।
ছোট খালু নিজেই কফি বানালেন। টিনের কোটা খুলে বিসকিট বের করলেন। কেক বের করলেন। অপ্ৰস্তুত ভঙ্গিতে বললেন, আলসারের মত হয়েছে। ডাক্তার শুধু চা কিংবা কফি খেতে নিষেধ করেছে। গরু ছাগলের মত সারাক্ষণই কিছু খাই।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, নিজের জন্যে এক্সটা খরচ করতে হচ্ছে — এই জন্যে মনটা সব সময় খচখচ করে?
খালু সাহেব লজ্জিত মুখে বললেন, হ্যাঁ, করে।
আচ্ছা খালু সাহেব, আপনার ঠিক কত টাকা আছে বলুন তো?
তেমনভাবে হিসেব করিনি। ভালই আছে।
ভালই মানে কি?
বেশ ভাল।
কোটির উপর হবে?
তা তো হবেই।
একটা মানুষের কোটির উপর টাকা আছে, সে নির্বিকার ভঙ্গিতে কফি বানাচ্ছে ভেবেই আমার শীত শীত করতে লাগল। অবশ্যি আজ এমিতেই শীত। কোন্ড ওয়েভ। শীতটা টের পাচ্ছিলাম না। এখন পাচ্ছি।
খালু সাহেব চলুন। একটা কাজ করি। এক রাতে আমরা দুটা ফিফটিন সিটার মাইক্রোবাস ভাড়া করি। বাস ভরতি থাকবে কম্বল। শীতের রাতে আমরা শহরে ঘুরবযেখানেই দেখব খালি গায়ে লোকজন শুয়ে আছে–ওমি দূর থেকে তাদের গায়ে একটা কম্বল ছুড়ে দিয়েই লাফ দিয়ে মাইক্রোবাসে উঠে পালিয়ে যােব। যাকে কম্বল দেয়া হয়েছে সে যেন ধন্যবাদ দেয়ার সুযোগও না পায়।
কাজটা কি জন্যে করব, সোয়াবের জন্যে? বেহেশতে যাতে হরপরী পাই? না সোয়াব-টোয়াব না, হঠাৎ দামী কম্বল পেয়ে লোকগুলির মুখের ভাব দেখে মজা পাওয়া। আপনার জীবনে নিশ্চয়ই মজার অংশ খুব কম। যাদের জীবনে মজার অংশ কম তারা অন্যদের মজা দেখে আনন্দ পায়। দুধের স্বাদ তাতের মাড়ে মেটানোর মত। খালু সাহেব সিগারেট ধরালেন। শান্ত মুখে সিগারেট টান দিচ্ছেন, কিছু বলছেন না। আমি কফি শেষ করে উঠে দাঁড়ালাম। ছোট খালু আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে বললেন, ঠিক আছে। বাস ভর্তি কম্বল দেয়া যাক। কবে দিতে চাও?