ভিক্ষুক মেছকান্দর মিয়া কি পাথরের রহস্যের কথা জানে?
জানতেও পারে। না জানলে সে তার ডেরায় ফেরার সময় এমন একটা ভারী পাথর বয়ে নিয়ে যায় কেন? ম্যানেজার সাহেব সিগারেট খাবেন?
জ্বি না, আমি ধূমপান করি না।
আপনাকে খুবই বিচলিত মনে হচ্ছে। শরীরে কিছু কাফিন ঢুকলে নাৰ্ভ শান্ত হতে পারে।
ম্যানেজার সাহেব সিগারেট নিলেন। সিগারেট ধরালেন। প্রথম টান দিচ্ছেন। তার নাৰ্ভ শান্ত হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। ঘাড়ের রগ ফুলে উঠেছে। চোখ-মুখ শক্ত।
ভদ্রলোকের বয়স চল্লিশ
ভদ্রলোকের বয়স চল্লিশও হতে পারে, আবার পঞ্চাশ পাঁচ পঞ্চাশও হতে পারে। রোদে জ্বলে যাওয়া চেহারা। মনে হয় দীর্ঘদিন ক্যানভাসারের চাকরি করেছেন— রোদে রোদে ঘুরেছেন। ক্যানভাসারদের মতই ধূর্ত চোখ। সারাক্ষণই ইদুরের মত চোখের মণি নড়ছে। চোখই বলে দিচ্ছে, মানুষটা অস্থির প্রকৃতির। গলার স্বর ভারী। আমার ধারণা, যে স্বরে উনি এখন কথা বলছেন সেই স্বরটা আসল না, নকল। বিশেষ বিশেষ কথা বলার সময় ভদ্রলোক সম্ভবত গলার স্বর বদলান।
তিনি আমার দিকে খানিকটা বুকে এলেন। গলার ভারী স্বর আরো ভারী করলেন। প্রায় ফ্যাসফেসে গলায় বললেন, বুঝলেন ভাই সাহেব, আপনাকে একজন জন্মান্ধ জোগাড় করতে হবে। তাকে দিয়ে লোকালয়ের বাইরে অমাবশ্যার রাত্ৰিতে একটা লাউগাছের বিচি পুততে হবে। বিচি পোঁতার সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে ছড়িয়ে দিতে হবে। কুমারী কন্যার ঋতুকালীন নষ্ট রক্ত। সেই কুমারী কন্যাকেও হতে হবে জন্মান্ধ!
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, আপনার দেখি জন্মান্ধেরই কারবার।
ভদ্রলোক আহত গলায় বললেন, আমাকে কথা শেষ করতে দিন। মাঝখানে কথা বললে হবে কিভাবে? আপনার যদি কিছু বলার থাকে আমি কথা শেষ করি তারপর বলবেন।
আমি আবারো হাই তুলতে তুলতে বললাম, জি আচ্ছা।
আমার এবারের হাইটা ছিল নকল। ভদ্রলোককে বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা যে তাঁর জন্মান্ধ বিষয়ক গল্প শুনতে ইচ্ছা করছে না। ভদ্রলোক এই সহজ সত্য ধরতে পারছেন না। তিনি গল্প শুনিয়ে ছাড়বেন।
এরপর আপনাকে যা করতে হবে তা হচ্ছে প্ৰতিদিন খালি পায়ে স্রোতস্বিনী নদী থেকে মাটির পাত্রে এক পাত্র করে পানি আনতে হবে। পানি আনার কাজটা করতে হবে মধ্যরাতে।
ও আচ্ছা।
পানি আনতে হবে উলঙ্গ অবস্থায়। তখন গায়ে কোন কাপড় থাকলে চলবে না। সেই পানি দিয়ে প্রতি রাতেই লাউ গাছের বীজ যে জায়গায় পুতেছেন, সেই জায়গাটা ভিজিয়ে দিতে হবে। যতদিন না বীজ থেকে অন্ধুরোদগম না হচ্ছে।
আমি আগ্রহশূন্য গলায় বললাম, ইন্টারেষ্টিং।
ভদ্রলোক আরো খানিকটা বুকে এলেন। আমি লক্ষ্য করলাম, ভদ্রলোকের গলা অন্য মানুষদের গলার চেয়ে লম্বা। তাঁর শরীরটা আগের জায়গাতেই আছে কিন্তু গলা লম্বার কারণে মাথাটা এগিয়ে এসেছে।
অন্ধুরোদগমের পর থেকে লাউগাছে প্রথম ফুল আসা পর্যন্ত আপনাকে ঠিক সন্ধ্যাবেলা হযরত মূসা আলায়হেস সালামের মায়ের সতেরোটা নাম পড়ে গাছে ফুঁ দিতে হবে।
সতেরোটা নাম আমি পাব কোথায়?
আপনাকে আমি লিখে দিচ্ছি। এক্ষুনি লিখে দিচ্ছি।
থাক, দরকার নেই।
দরকার নেই কেন?
কাগজ আমি রাখব কোথায়? আমার পাঞ্জাবীর পকেট নেই।
ভদ্রলোক আহত গলায় বললেন, আপনি মনে হয় আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছেন না। ঘন ঘন হাই তুলছেন। অবশ্যি বিশ্বাস করা কঠিন।
আমি হাসিমুখে বললাম, বিশ্বাস করছি। প্রতিটি শব্দ বিশ্বাস করছি। কারণ বিশ্বাসে মিলায় বন্ধু—তর্কে বহুদূর।
মন্ত্রতন্ত্রের কথা আমি কাউকে বলি না। মানুষের মনে ঢুকে গেছে অবিশ্বাস। অবিশ্বাসীদের এইসব বলে লাভ নেই। আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে বলে বলছি। তাছাড়া আমি বেশিদিন বাঁচব না। সারাজীবনের সঞ্চয় কিছু মন্ত্ৰ-তন্ত্র কাউকে দিয়ে যেতে চাই। আরেক কাপ চা খাবেন?
জ্বি না।
খান, আরেক কাপ খান। চায়ের সঙ্গে কোন নাশতা দেব? মুড়ি আছে? মুড়ি মেখে দিতে বলি?
বলুন।
ভদ্রলোক বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলেন। আমি বসে আছি। অন্ধকারে। আমার সামনে এতক্ষণ একটা হারিকেন ছিল। ভদ্রলোক ভেতরে ঢোকার সময় হারিকেন নিয়ে গেছেন। ঢাকায় বিখ্যাত লোড শেডিং। শুরু হয়েছে। দুঘন্টার আগে ইলেকট্রিসিটি আসবে না। এখন শীতকাল গরম লাগার কথা না। কিন্তু গরমে শরীর ঘেমে গেছে। ইলেকট্রিসিটি এলেও এই গরমের হাত থেকে বাঁচা যাবে না। কারণ বসার ঘরে ফ্যান নেই। ভদ্রলোক গল্প করার সময় প্রবলবেগে হাওয়া করছিলেন। তিনি ভেতরে ঢোকার সময় হারিকেনের সঙ্গে হাতপাখাও নিয়ে গেছেন।
ভদ্রলোকের আচার-আচরণের মধ্যে কিছু মজার ব্যাপার আছে— ভেতরের বাড়িতে ঢুকলে সহজে বের হতে চান না। মুড়ির কথা বলে ভেতরে ঢুকেছেন, আর বের হচ্ছেন না। কখন বের হবেন কে জানে।
ইনিই আমাদের মুহাম্মদ ইয়াকুব। বাবা-সুলায়মান, গ্ৰাম— নিশাখালি, জেলা— নেত্রকোনা। ভদ্রলোক কবিরাজ হলেও কথাবার্তায় মনে হচ্ছে মন্ত্ৰ-তন্ত্র যাদু-টোনার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ।
ইয়াকুব সাহেব আমাকে খানিকটা পছন্দ করেছেন বলে মনে হচ্ছে। আজ নিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার তৃতীয় দফা সাক্ষাং এর মধ্যেই তিনি আমাকে অদৃশ্য হবার মন্ত্র শেখাচ্ছেন। অবশ্য এটা তাঁর কোন একটা কৌশলও হতে পাবে। ধূর্ত মানুষদের নানান ধরনের কৌশল থাকে। মন্ত্র-তন্ত্রের কথা বলে আমাকে অভিভূত করার চেষ্টা করছেন। আমি অভিভূত হচ্ছি না। এ ব্যাপারটাও সম্ভবত ভদ্রলোকের মনোবেদনার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।