খট করে শব্দ হল। ভদ্রলোক টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। ওসি সাহেব চিন্তিত এবং বিরক্তমুখে বললেন, আপনি শুধু যে নিজে বিপদে পড়েছেন তা না। আপনি তো মনে হয় আমাকেও বিপদে ফেলেছেন। অনেক টাকা-পয়সা খরচ করে ঢাকায় পৌষ্টিং নিয়েছি— বিরাট ইনভেষ্টমেন্ট। ইনভেষ্টমেন্টের দশ ভাগের এক ভাগও এখনো তুলতে পারিনি। এর মধ্যে যদি বদলি করে দেয় তাহলে আম-ছালা সবই যাবে। শুধু পড়ে থাকবে আমের আট। ভাল কথা, ভদ্রলোকের বুকে কি সত্যি ব্যথা উঠবে?
জ্বি উঠবে। আমার আধ্যাত্মিক ক্ষমতার জন্যে না। এমিতেই উঠবে। মানসিক ভাবে দুর্বল তো তার জন্যে মনে একটা চাপ আছে। এ চাপ শরীরে চাপ ফেলবে। বুকে তীব্র ব্যথা হবে। এও হতে পারে— ব্যথা ট্যাথা কিছু হল না, কিন্তু মনে হবে ব্যথা হচ্ছে। স্যার, আমার বন্ধুকে ছাড়ার ব্যবস্থা করবেন না?
করছি। সিগারেট খাবেন?
জি খাব।
ব্যাঙচি বিশ্বাসই করছে না যে তাকে ছেড়ে দিচ্ছে। সে একই সঙ্গে আনন্দিত এবং দুঃখিত। তাকে ছেড়ে দিচ্ছে এই আনন্দ তার রাখার জায়গা নেই। আবার আমাকে আটকে রেখেছে। এই দুঃখেও সে আসলেই বিপর্যন্ত।
দোস্ত তোকে রেখে চলে যেতে খুবই খারাপ লাগছে।
আমাকে তো রেখে যেতেই হবে। আমি দোষ করেছি। গিল্টি পার্টি। তুই তো দোষ করিসনি।
তা ঠিক। তোর ভাবীর অনেক বড় বড় আত্মীয়-স্বজন আছে। তাদের ধরলেই তোর রিলিজের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কিন্তু তোর ভাবীকে কিছুই বলা যাবে না। বুদ্ধিমতী মেয়ে তো, তোর কথা বললেই সে বলবে –তোমার বন্ধু হাজতে সেই খবর তোমাকে কে দিল? আমি তার জেরার মুখে পড়ে স্বীকার করে ফেলব। যে আমিও হাজতে ছিলাম। দাবানল লেগে যাবে, বুঝলি।
বুঝতে পারছি।
শোন দোস্ত। তুই আশা ছাড়িস না, আমি ধর্মীয় লাইনে চেষ্টা করব। আমাদের বাড়ির পাশেই এক হাফেজ সাহেব আছেন। এক হাজার টাকায় কোরান খতম দেন। আর্জেন্ট ব্যবস্থাও আছে। খুব ইমার্জেন্সি হলে মাদ্রাসার তালেবুল এলেমদের নিয়ে চার ঘন্টায় খতম শেষ করে দোয়া করে দেন। দোস্ত তোর জন্যে এক্সটা ফি দিয়ে আর্জেন্ট দোয়া করাব। ইনশাল্লাহ আমি কথা দিলাম। আর আমি রোজ এসে তোর খোঁজখবর করব। টিফিন কেরিয়ারে করে খাওয়া নিয়ে আসব। প্রমিজ।
কিছু আনতে হবে না।
অবশ্যই আনতে হবে। তুই না খেয়ে থাকিবি? দোস্ত মনে ভরসা রাখ–কাল সকালের মধ্যে খতম সন্টার্ট হবে। ইনশাল্লাহ।
আমাকে হাজতে থাকতে হল। তিনদিন। ওসি সাহেবের সঙ্গে এই তিনদিন আমার কথা হল না। তিনি অসম্ভব ব্যস্ত। কোন একটা ঝামেলা হয়েছে –দিন রাত চবিবশ ঘটাই তাকে ছোটাছুটি করতে হচ্ছে। এই তিনদিনে ব্যাঙাচির কোন খোঁজ নেই। তার টিফিন কেরিয়ার নিয়ে আসার কথা।
চতুর্থ দিন সকালে ওসি সাহেব আমাকে ছেড়ে দিয়ে ক্লান্তমুখে বললেন, যান, চলে যান।
চলে যাব?
হ্যাঁ, চলে যাবেন। গত পরশুই আপনাকে ছেড়ে দেবার কথা। আমি অপারেশনে যাবার আগে সেকেণ্ড অফিসারকে বলে গিয়েছিলাম। আপনাকে ছেড়ে দিতে। সে ভুলে গেছে। কিছু মনে করবেন না –দুদিন এক্সটা হাজতবাস হল।
আপনাকে কবীরের দোঁহার ব্যাখ্যাটা তো বলা হল না।
ব্যাখ্যা বাদ দেন। আমার জান নিয়ে টানাটানি। খুব সমস্যায় আছি। এক কাপ চা খান— চা খেয়ে চলে যান। মনে কোন কষ্ট পুষে রাখবেন না। প্রতিমন্ত্রীর শালা টেলিফোন করে আমাকে বলেছেন যে, তিনি দুঃখিত–এই খবরটা যেন আপনাকে দেয়া হয়। আমি দিলাম। কাজেই আমার দায়িত্ব শেষ।
উনার কি ব্যথা উঠেছিল?
ব্যথার খবর জানি না। উঠেছে তো বটেই। হাসপাতাল থেকে টেলিফোন হয়েছে। গলা চিঁচিঁ করছে। আপনি ইন্টারেষ্টিং ক্যারেক্টর।
থ্যাংক য়ু।
আমি ওসি সাহেবের সঙ্গে চা খেলাম। ওসি সাহেব দুঃখিত গলায় বললেন, মনটা খুবই খারাপ। মনে হয়। আমাকে বদলি করে খাগড়াছড়ি-টরির দিকে পাঠাবে। শান্তি বাহিনীর ডলা খাব।
শান্তি চুক্তি তো হয়ে গেছে, এখন আর কিসের ডলা?
এখনকার ডলা হবে। আপোসের ডলা। শান্তি শান্তি ভাবে হাসতে হাসতে ডলা। যাই হোক, বাদ দেন। চায়ের সঙ্গে কিছু খাবেন?
একটা সিগারেট খাব।
ওসি সাহেব সিগারেট দিলেন। লাইটার জ্বলিয়ে সিগারেট ধরাতে এসেছেন। বাতাসের জন্যে ধরাতে পারছেন না। বাতাসে লাইটারের আগুন নিভে যাচ্ছে। তিনি মহা বিরক্ত আমি ওসি সাহেবকে বললাম, একটা মজার কথা কি জানেন ওসি সাহেব! ছোট্ট আগুনের শিখা বাতাসে নিভে যায়। কিন্তু বিশাল যে আগুন, যেমন মনে করুন দাবানল, বাতাস পেলে ফুলে-ফেঁপে উঠে।
ওসি সাহেব বললেন, এটাও কি কবীরের দোঁহা?
জ্বি না, এটা হিমুর দোঁহা৷
হিমুটা কে?
আমিই হিমু।
ও আচ্ছা, আপনি হিমু একবার বলেছিলেন। ভুলে গিয়েছি। কিছু মনে থাকে না। এমন এক বিপদে আছি যা বলার না। কারো সঙ্গে পরামর্শও করতে পারছি না। এটা এমনই এক সেনসেটিভ ইসু যে পরামর্শও করা যাচ্ছে না। ইয়ে তাল কথা, আপনি পরামর্শ কেমন দেন?
খুবই খারাপ পরামর্শ দেই। আমার পরামর্শ যে শুনবে তার অবস্থা কাহিল।
শুনি আপনার পরামর্শটা।
ঘটনা না শুনে পরামর্শ দেব কিভাবে?
ওসি সাহেব গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বললেন, একটা রেপ হয়েছে। অল্প বয়েসী। একটা মেয়েকে তার স্বামীর সামনে তিন মস্তান রেপ করেছে। মস্তান তিনটার আবার খুব ভাল পলিটিক্যালে কানেকশান আছে। মেয়ে এবং মেয়ের স্বামী এদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।
আপনাকে চাপ দেয়া হচ্ছে মামলা ভণ্ডুল করে দিতে?