কি রকম?
তাঁর ধারণা হল— যদি ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে পাঠিয়ে ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার বানানো যায়, ডাক্তার স্কুলে পাঠিয়ে বানানো যায় ডাক্তার, তাহলে মহাপুরুষ বানানোর স্কুলে পাঠিয়ে ছেলেকে কেন মহাপুরুষ বানানো যাবে না।
মহাপুরুষ বানানোর স্কুল আছে নাকি?
জ্বি না, বাবা একটা স্কুল দিয়েছিলেন। তিনিই ছিলেন স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল আর আমি তাঁর ছাত্র। প্রথম এবং শেষ ছাত্র।
স্কুলে কি শেখানো হত?
নির্দিষ্ট কোন সিলেবাস ছিল না। প্ৰিসিপ্যাল সাহেবের মাথায় যখন যা আসত তাই ছিল পাঠ্যক্রম। একটা উদাহরণ দেই। আমি অন্ধকারে ভয় পেতাম। সেই ভয় কাটানোর জন্যে তিনি একদিন একরাতে আমাকে বাথরুমে তালাবন্ধ করে রেখেছিলেন। আমার বয়স তখন সাত।
বলেন কি, এ তো পাগলের কান্ড।
আগেই তো বলেছি। বাবা পাগল ছিলেন।
আপনার মা বাধা দেননি?
মা যাতে বাধা দিতে না পারেন সেই জন্যে মাকে মেরে ফেলেছিলেন। বাবার ধারণা মাতৃস্নেহ মহাপুরুষ হবার প্রক্রিয়ায় বড় বাধা। মহাপুরুষকে সব রকম বন্ধন থেকে মুক্ত হতে হবে। মোহের বন্ধন, মায়ার বন্ধন, ভালবাসার কন্ধন।
আই সি। বাবার ট্রেনিং এর ফলে আপনি কি মহাপুরুষ হয়েছেন?
জ্বি না। মনে হয়। পাশ করতে পারিনি। ফেল করেছি। তবে…..
তবে আবার কি?
লোকজনদের খানিকটা বিভ্রান্ত করতে পারি। এটা মহাপুরুষদের একটা লক্ষণ। মহাপুরুষদের কর্মকান্ডে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়। সত্যি করে বলুন তো স্যার আপনি কি বিভ্ৰান্ত হননি?
আমি বিভ্ৰান্ত হয়েছি?
জ্বি হয়েছেন। আপনার মনে সন্দেহ ঢুকে গেছে। আপনি ভাবছেন –হলুদ পাঞ্জাবী পরা এই লোকটা মহাপুরুষ হলেও তো হতে পারে। আপনার মন দুর্বল বলেই সন্দেহটা প্ৰবল।
আমার মন দুর্বল?
জ্বি স্যার— ঘুষ যারা খায় তাদের মন দুর্বল থাকে।
আই সি।
আপনি কি স্যার দয়া করে আমার বন্ধুকে ছেড়ে দেবেন?
ওসি সাহেব বেশ কিছুক্ষণ ঝিম ধরে রইলেন। এক সময় তাঁর ঝিম কাটল। তিনি মিনিট তিনেক পা নাচালেন। মানুষ সাধারণত একটা পা নাচায়— উনি দুটা পা এক সঙ্গে নাচাচ্ছেন। দেখতে ভাল লাগছে। পা নাচানো থামল। ওসি সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে যান— আপনার বন্ধুকে আমি ছেড়ে দিচ্ছি। আপনি কিন্তু আছেন।
অবশ্যই আছি। আপনাকে কবীরের দুই লাইনের ব্যাখ্যা না দিয়ে আমি যাব না।
চা খাবেন?
জ্বি চা খাব এবং একটা সিগারেট খাব। স্যার আরেকটা কথা, হাজতে ঢুকানোর পর কি একটা টেলিফোন করার সুযোগ পাওয়া যায় না। আত্মীয় –স্বজনকে জানানো যে, দয়া কর, দুশ্চিন্তা কর— আমি হাজতে আছি।
টেলিফোন করতে চান?
জ্বি চাই।
কাকে ফোন করবেন, প্রধানমন্ত্রীকে?
জ্বি না। স্যার, আমি আপনাকে আগেই বলেছি যে আমি অত্যন্ত ক্ষুদ্র ব্যক্তি। জীবাণু টাইপ। জীবাণুর চেয়েও ছোট-ভাইরাস বলতে পারেন।
ভাইরাস মাঝে মাঝে ভয়ংকর হয়।
জ্বি স্যার, তা হয়।
নাম্বার বলুন আমি লাগিয়ে দিচ্ছি।
মন্ত্রী সাহেবের শালার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছি। উনার টেলিফোন নাম্বার তো আপনি রেখে দিয়েছেন। তাই না?
টেলিফোনে কি বলবেন?
সেটা এখনো ঠিক করিনি। বাংলাদেশ আইনে আমি হাজত থেকে একটা টেলিফোনের সুযোগ পাই। সেই সুযোগ ব্যবহার করতে চাচ্ছি।
আচ্ছা দেখি –উনি কথা বলতে চান। কিনা কে জানে।
ওসি সাহেব নিচু গলায় ভদ্রলোকের সঙ্গে আগে কিছুক্ষণ কথা বললেন। আমার সম্পর্কে কিছু বললেন বোধহয়। তারপর টেলিফোন আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমি আনন্দিত গলায় বললাম—কেমন আছেন ভাই। আমি হিমু।
কি চান আমার কাছে?
আমি আল্লাহর কাছেই কিছু চাই না, আর আপনার কাছে কি চাইব?
বড় বড় কথা শিখেছেন। মুখের চেয়ে জিহ্বা বড়। জিহবা এখন সাইজ মত কাটা পড়বে।
স্যার আপনার বুকের ব্যথাটার খবর কি শুরু হয়েছে?
তার মানে?
আমি একজন মহাপুরুষ টাইপ জিনিস। আপনি আমার নামে মিথ্যা ডাইরী করেছেন। তার শাস্তি হিসেবে আপনার বুকে ব্যথা শুরু হবার কথা। এখনো হচ্ছে না। কেন বুঝতে পারছি না।
চড়িয়ে দাঁত ফেলে দেব হারামজাদা।
স্যার, ব্যথাটা খুব বেশি হলে দেরি না করে সোহরাওয়াদী হাসপাতালে চলে যাবেন। এনজিষ্ট ট্যাবলেট আনিয়ে রাখুন। জিভের নিচে দিতে হবে।
টেলিফোনের ওপাশে ভদ্রলোক রাগে থর থর করে কাঁপছেন। ভদ্রলোককে দেখা না গেলেও বোঝা যাচ্ছে। আমি তাঁর রাগ সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে হাসিমুখে বললাম, আমার নামে মিথ্যা এফ আই আর করিয়েছেন— এটা ঠিক হয়নি। বুকের ব্যথা উঠামাত্র থানায় ওসি সাহেবকে সত্যি কথাটা জানাবেন। ব্যথা কমে যাবে। আপনার দুলাভাই মিথ্যা বললে কোন সমস্যা না, তিনি মন্ত্রী মানুষ। মিথ্যা তিনি বলবেন না তো কে বলবে? তিনি সত্যি কথা বললেই সমস্যা।
সত্যি কথা বললে সমস্যা মানে?
মন্ত্রীরা মিথ্যা বলেন এটা ধরে নিয়েই আমরা চলি। এতে সিষ্টেম অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কাজেই হঠাৎ একজন মন্ত্রী যদি সত্যি কথা বলা শুরু করেন তাহলে সমস্যা হবে না?
ফর ইওর ইনফরমেশন –আমার দুলাভাই কখনোই মিথ্যা বলেন না। এমপিরা ট্যাক্স ফ্রি গাড়ি পায় আপনি বোধহয় জানেন। সংসদে সব এমপিরা কোন বিষয়েই একমত হন না, শুধু ট্যাক্স ফ্রি গাড়ির বিষয় ছাড়া। সেখানে আমার দুলাভাই ট্যাক্স ফ্রি গাড়ি নেননি।
আমি যে গাড়িতে চড়তে চাইলাম সেটা তাহলে কার?
আমার।
স্যার আপনি কি করেন?
ব্যবসা।
গার্মেন্টস?
ঠিক ধরেছেন।
আপনাদের গার্মেন্টসে কি হলুদ পাঞ্জাবী হয়? আমাদের দুটা হলুদ পাঞ্জাবী দিতে পারবেন? একটা আমার জন্যে, একটা ওসি সাহেবের জন্যে। আমার সাইজ চৌত্ৰিশ। ওসি সাহেবের ছয়ত্রিশ। এক্সটা লার্জ কিনলেই হবে।