ব্যাঙচি করুণ চোখে তাকিয়ে আছে। তার কপাল ঘামছে। ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। মনে হয় কোন দোয়া-টোয়া পড়ছে। নিয়ামুল কোরানে কোন বিপদে কোন দোয়া পড়তে হয় তার বিবরণ আছে। ঝড়ের সময়ে দেয়া, আগুন লাগলে দোয়া, দামী জিনিস হারিয়ে গেলে খুঁজে পাবার দেয়া… পুলিশের হাতে পরলে কোন দেয়া পড়তে হবে সেটা নেই। থাকলে জনগণের উপকার হত।
ওসি সাহেব প্ৰথমে আমাকে ডাকলেন। তাও ঠিক সন্ধ্যার আগে আগে। ভদ্রলোক গভীর প্রকৃতির। চেহারার মধ্যেই একটা ঘুষ খাই, ঘুষ খাই ভাব। মাঝে মাঝে জিব বের করে ঠোঁট চাটেন। চাটা দেখে মনে হয় ঠোঁটে অদৃশ্য চিনি মাখানো। জিব দিয়ে সেই চিনি চেটে নিয়ে মজা করে খাচ্ছেন।
অ্যাপনার নাম?
স্যার, আমার ভাল নাম হিমালয়। ডাক নাম হিমু।
হাজতে এই প্রথম এসেছেন, না। এর আগেও এসেছেন?
এর আগেও বেশ কয়েকবার এসেছি।
তাহলে তো আপনি আত্মীয়ের মধ্যেই পড়েন। কখনো কনভিকশান হয়েছে?
জ্বি না। হাজত থেকেই ছাড়া পেয়ে গেছি।
এইবার পাবেন না। এইবার জেলখানার ল্যাপসি খাওয়াবার ব্যবস্থা করে দেব।
জ্বি আচ্ছা।
মনে হচ্ছে আমার কথা শুনে মজা পাচ্ছেন। মজার ইংরেজী জানেন?
জানি স্যার –ফান।
এইবার আপনার ফানের ব্যবস্থা করে দেব। গাড়ি ভাঙ্গতে খুব মজা লাগে?
স্যার, আপনার সামান্য ভুল হয়েছে। আমি গাড়ি ভাঙ্গিনি। অতি ভদ্রভাষায় লিফট চেয়েছিলাম। উনি লিফট দেয়ার নাম করে থানায় নিয়ে এসেছেন।
তই নাকি?
জ্বি স্যার, এটাই ঘটনা। বাংলাদেশ পেনাল কোডে –কথা দিয়ে কথা না রাখার কি কোন শাস্তি আছে? যদি থাকে তাহলে তাঁর শাস্তি পাওয়া উচিত।
অপনি কি নিজেকে অতিরিক্ত চালাক ভাবেন?
জ্বি না, ভাবি না। তবে স্যার, সত্যি কথা বলতে কি — আমি যেমন নিজেকে চালাক ভাবি না–অন্যকেও ভাবি না।
আপনি কার গাড়ি ভেঙ্গেছেন সেটা জানেন?
স্যার, আমি কারোর গাড়ি ভাঙ্গিনি। তবে যিনি গাড়ি ভাঙ্গার কথা বলছেন তিনি ক্ষমতাবান মানুষ মন্ত্রীর শ্যালক। এই তথ্য জানি।
তিনি এফ আই আর করে গেছেন— আপনি এবং আপনার বন্ধু মিলে তাঁর গাড়ি ভেঙ্গেছেন। এবং আগে একদিন তাঁকে ভয় দেখিয়েছেন। থান ইট দিয়ে তার মাথা ভেঙ্গে দিতে চেয়েছিলেন।
থান ইট দিয়ে মাথা ভেঙ্গে দেবার কথাটা সত্যি না হলেও ভয় দেখাবার ব্যাপারটা সত্যি।
ভয় কিভাবে দেখিয়েছেন?
ভেঙচি কেটেছি। বাচ্চারা কাউকে ভেঙচি দিলে ভয় লাগে না। কিন্তু বড় কোন মানুষ ভেঙচি কাটলে বুকে ধাক্কার মত লাগে। কিভাবে ভেঙচি কেটেছিলাম সেটা কি স্যার ডেমনসট্রেট করে দেখাব?
অবশ্যই দেখাবেন। আপনার মত ফাজিলদের কি চিকিৎসা আমরা করি সেটা আগে একটু ডেমনসট্রেট করে দেখাই। প্রথমে আমাদের ডেমনসট্রেশন, তারপর আপনারটা।
আপনাদের কর্মকাণ্ড শুরু হবার আগে আমি কি একটা কথা বলতে পারি?
পারেন।
আপনার বোধহয় মনে আছে যে, আপনাকে আমি শুরুতেই বলেছি, আমি এর আগে বেশ কয়েকবার হাজতে এসেছি। প্ৰতিবারই ছাড়া পেয়েছি। কোন কনভিকশন হয়নি। তা থেকে কি প্রমাণিত হয় না যে, আমিও ক্ষমতাবান একজন মানুষ। মন্ত্রীর শালার চেয়েও আমার ক্ষমতা বেশি। কাজেই আপনি যা করবেন ভেবেচিন্তে করবেন। ইংরেজী ঐ বাক্যটা আশা করি আপনি জানেন–
Look before you leap.
ঝাঁপ দেবার আগে ভাল করে দেখা। একবার ঝাঁপ দিয়ে ফেললে কিন্তু সমস্যা।
ওসি সাহেব জিভ চাটা বন্ধ করেছেন। সরু চোখে তাকাচ্ছেন। ভেতরে একটু যে থমকে গেছেন তা বোঝা যাচ্ছে। কাজেই এই সুযোগটা নিতে হবে। ওসি সাহেবকে ভড়কে দিতে পারলে কিল-থাপ্পড় থেকে আপাতত রক্ষা পাওয়া যাবে।
আপনি বলতে যাচ্ছেন যে আপনি একজন বিগ শট?
জ্বি না, আমি অত্যন্ত ক্ষুদ্র প্রাণী –ভেরী স্মল শট। জীবাণু টাইপ। আমার পাজেরো গাড়ি নেই, মন্ত্রী দুলাভাই নেই— এবং পয়ে জুতা পর্যন্ত নেই। যদি কিছু মনে না। করেন–কবীরের একটা দোঁহা আপনাকে শুনাতে পারি?
কারে কি শুনাতে চাচ্ছেন?
কবীরের দোঁহা –কবীর বলছেন,
হরি নে আপনা আপ ছিপায়।
হরি নে নফৗজ কর দিখরায়া–
এর মানে কি?
এর মানে হচ্ছে, ঈশ্বর আপনাকে আপনি লুকিয়ে রাখেন। আবার কি অদ্ভুত সুন্দর করেই না নিজেকে প্ৰকাশিত করেন।
আপনি কি বলতে চাচ্ছেন কিছুই বুঝতে পারছি না। এই যে লাইন দুটা বললেনএর মানে কি?
মানে তো আপনাকে বললাম।
ব্যাখ্যা করেন।
ব্যাখ্যা করতে সময় লাগবে।
কত সময় লাগবে?
দুই তিন দিন সময় লাগবে। এক কাজ করুন, আমাকে দুই তিন দিন হাজতে রেখে দিন। আমি লাইন দুটার ব্যাখ্যা করব। তবে একটা শর্ত আছে।
কি শর্ত?
আমার বন্ধুকে ছেড়ে দিতে হবে।
ও আচ্ছা।
ও আচ্ছা বলার দরকার নেই। মন্ত্রীর শালাবাবুর কাছে অপরাধ যা করেছি। আমি করেছি। আমার বন্ধু করেনি। ওকে ছেড়ে দিন— আপনার লাভ হবে।
কি লাভ হবে?
সেটা যথাসময়ে দেখবেন। লাভ-লোকশান প্রসঙ্গেও কবীরের একটা দোঁহা আছে বলব?
দোঁহা ফোহা বাদ দিন। ঝেড়ে কাশুন। আপনি কে ঠিক করে বলুনঃ আপনার ব্যাক গ্ৰাউন্ড কি? আপনি করেন কি?
আমি স্যার কিছুই করি না। হলুদ পাঞ্জাবী পরে পথে পথে হাঁটি।
অ্যাপনার চলে কি ভাবে?
এত বড় একটা শহরে একজন মানুষের বেঁচে থাকা কোন কঠিন ব্যাপার না।
পথে পথে ঘুরেন কেন?
আমার বাবার জন্যে পথে পথে ঘুরি। আমার বাবার মাথা ছিল খারাপ। বাইরে থেকে কেউ বুঝতে পারত না। তাঁর সমস্ত আচার-আচরণ ছিল স্বাভাবিক মানুষের মত। শুধু চিন্তা ভাবনা ছিল পাগলের মত।