ভদ্রলোককে খুব চেনা চেনা লাগছে। কোথায় দেখেছি বুঝতে পারছি না। সানগ্লাস খুললে হয়ত চিনতে পারব।
আপনি কি চাচ্ছেন?
স্যার, আমরা দুই বন্ধু আপনার কাছে লিফট চাচ্ছি। আমাদের অতীশ দীপংকর রোডে নামিয়ে দিন।
লিফটের জন্য হাত উঁচিয়ে গাড়ি থামালেন?
জি।
আসুন, উঠে আসুন। আপনার বন্ধুকেও ডাকুন।
ব্যাঙচি গাড়িতে উঠতে উঠতে বলল, দোস্ত, তোর প্রতিভা দেখে আমি মুগ্ধ। তুই তো মানব না, মহামানব। গাড়িতে লোকজন না থাকলে আমি তোর পায়ের ধুলা নিতাম।
গাড়ি অতীশ দীপংকর রোডের দিকে গেল না। রমনা থানার সামনে থামল। চশমা। পরা ভদ্রলোক বললেন, আপনার নামুন। আমি আপনাদের পুলিশের কাছে হ্যান্ডওভার করব।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন?
আমাকে চিনতে পারছেন না?
চেনাচেনা লাগছে। আপনি কি বিখ্যাত কেউ?
আমি বিখ্যাত কেউ না। আগে একদিন আপনি আমাকে উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন। আমি গাড়ির কাচ তুলে দিলাম-আপনি বাইরে থেকে ভেংচি কাটছিলেন। নানান অঙ্গভঙ্গি করছিলেন। এখন চিনতে পেরেছেন?
জ্বি। এখন চিনতে পারছি। চোখে সানগ্লাস থাকায় চিনতে অসুবিধা হচ্ছিল।
আজ আবার গাড়ি আটকেছেন। ইউ আর এ পাবলিক নুইসেন্স। পুলিশের উচিত আপনাদের সম্পর্কে খোঁজখবর করা।
ব্যাঙচি শুকনো গলায় বলল, স্যার আপনি কিছু মনে করবেন না। আমরা হেঁটে হেঁটে অতীশ দীপংকর রোডে চলে যাব। হাঁটাটা স্বাস্থ্যের জন্যেও ভাল। আপনি চলে যান, আপনাকে শুধু শুধু দেরি করিয়ে দিলাম। আমরা দুই বন্ধুই আন্তরিক দুঃখিত। আওয়ার এপলজি।
এপলজিতে কাজ হল না। রমনা থানার সেকেন্ড অফিসার বিরসমুখে আমাদের হাজতে ঢুকিয়ে দিলেন। এছাড়া তার উপায়ও ছিল না। যে ভদ্রলোক আমাদের নিয়ে এসেছেন। তিনি এক প্রতিমন্ত্রীর শালা। মন্ত্রীর শালদের ক্ষমতা মন্ত্রীদের চেয়ে অনেক বেশি থাকে। মন্ত্রী তাঁর পাজেরো গাড়ি নিয়ে যত ঘুরেন— তার শালা তার চেয়ে বেশি। ঘুরেন। এটাই নিয়ম।
ব্যাঙচি পুরোপুরি হকচকিয়ে গেছে। তার করুণ মুখ দেখে মায়া লাগছে। কেঁদেটোদে ফেলবে কিনা বুঝতে পারছি না। সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। সম্ভবত এটাই তার প্রথম হাজত বাস।
ব্যাঙচি হতভম্ব গলায় বলল, দোস্ত, সর্বনাশ হয়ে গেলো তো।
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, সর্বনাশের কি আছে?
তোর ভাবী যখন শুনবে আমি হাজতে তখন অবস্থাটা কি হবে বুঝতে পারছিস না?
ভাবী খুশিও হতে পারে। হাজতে থাকা মানে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ। ভাবীর তো খুশি হবারই কথা।
হাজতে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ মানে? এরা খেতে দেয় না?
পার হেড এক টাকা পঞ্চাশ পয়সা বাজেট। এই টাকায় কি খাবি? এর আগে একবার হাজতে আমি সারাদিনে একটা কলা খেয়েছিলাম। অবশ্যি বেশ বড় সাইজ কলা।
তুই কি এর আগেও হাজতে ছিল নাকি?
থাকি মাঝে মধ্যে।
কি সর্বনাশ বলিস কি? তোর সঙ্গে মেশা, তো ঠিক হয়নি।
এবার ছাড়া পাবার পর আর মিশিস না।
ছাড়া পাব কিভাবে?
আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে পুলিশের বড় কর্তা, কিংবা মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী কেউ আছে?
না।
মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর শালাদের কারোর সঙ্গে মহব্বত আছে?
তোর ভাবীর থাকতে পারে। আমার নেই।
শেখ হাসিনা, কিংবা বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে পরিচিত কেউ কি আছে যে তোকে চেনে?
আমার জানা মতে নেই। তবে তোর ভাবীর থাকতে পারে। ওর কানেকশন ভাল।
তাহলে টেলিফোন করে ভাবীকে বল। ভাবী একটা-কিছু ব্যবস্থা করবে।
সর্বনাশ তোর ভাবীকে জানানোই যাবে না। কারবালা হয়ে যাবে। পুলিশ শুনেছি ঘুষ খায়। এরা খাবে না?
প্রতিমন্ত্রীর শালা এসে আমাদের দিয়ে গেছে তো—পুলিশ এখন আর ঘুষ খাবে না। তবে আমাদের নিজে থেকে উচির পান খাওয়ার জন্যে তাদের কিছু দেয়া। মারের হাত থেকে বাঁচার জন্যেই দিতে হবে।
ব্যাঙচি আৎকে উঠে বলল, মারবে নাকি?
মারবে তো বটেই। কথা বের করার জন্যে মারবে। ইন্টারোগেশনের টাইমে হেভি ধোলাই দিতে পারে। তোর সঙ্গে কথা বলছে, কথা বলছে—স্বাভাবিক ভাবেই বলছে, আচমকা গদাম করে তলপেটে এক ঘুষি।
বলিস কি? ইন্টারোগেশন কখন হবে?
ওসি সাহেবের সময় হলেই হবে। যত দেরিতে উনার সময় হয় ততই ভাল। এত দুঃচিন্তা করে লাভ নেই। ঘুমিয়ে থাক।
হিমু।
বল।
দোস্ত, তুই কিছু মনে করিস না। তোকে একটা সত্যি কথা বলি। তোর সঙ্গে মেশা আমার ঠিক হয়নি। বিরাট ভুল হয়েছে। গ্রেট মিসটেক। তোকে ভাল মানুষের মত দেখালেও তুই আসলে ডেঞ্জারাস।
আর মিশিস না।
মিশিস না বললেই তো হবে না। তুই আমার বাল্যবন্ধু।
বিপদের সময় বাল্য-বন্ধু, বৃদ্ধ-বন্ধু কোন ব্যাপার না।
এটাও ঠিক বলেছিস। দোস্ত, এখানে বাথরুমের কি ব্যবস্থা? আমার টেনশনে বাথরুম পেয়ে গেছে।
ছোট বাথরুম হলে এক কোণায় বসে পড়। হাজাতের সেলে ছোট বাথরুম করা যায়। কেউ কিছু বলে না। বড়টা হলে সমস্যা আছে।
কি সমস্যা?
সেট্রিকে ডাকতে হবে। তার যদি দয়া হয়। বাথরুমে নিয়ে যাবে।
দয়া না হলে?
দয়া না হলে দয়া তৈরি করার সিষ্টেম আছে। টাকা দিলেই দয়া তৈরি হয়।
আমাদের সঙ্গে তো টাকা নেই।
তোর কি বড়টা পেয়েছে?
হুঁ। সকালবেলা বাউলস ক্লিয়ার হয়েছে— এখন এই টেনশানটায় সিষ্টেমে গন্ডগোল— আগামীকাল সকালে যেটা হবার কথা সেটা এখন হতে চাচ্ছে। দোস্ত কি করব?
দেখি, সেন্ট্রিকে ডাকি।
যদি রাজি না হয়? দোস্ত আমার পানির পিপাসাও পেয়েছে। এখানে পানি খাবার সিস্টেম কি?
বাথরুমে যখন নিয়ে যাবে ঐ সময় পানি খেয়ে নিবি। উটের মত বেশি করে খাবি। যাতে জমা করে রাখতে পারিস। আবার পানি খাবার সুযোগ কখন হবে কে জানে।