ইনশাল্লাহ হবে।
তুই যদি কুড়ি হাজার টাকা পেয়ে যাস তাহলে ভালমত একবেলা খাওয়াবি।
অবশ্যই খাওয়াব।
প্ৰমিজ করছিস তো?
হ্যাঁ, প্রমিজ।
তোকে আমি সাহায্য করব। জান দিয়ে সাহায্য করব। ঐ লোকটাকে খুঁজে বার করব। পথেঘাটে খুঁজলে হবে না। সিস্টেমেটিকালি খুঁজতে হবে। প্ল্যান করে এগুতে হবে।
আয় প্ল্যানটা করি?
ব্যাঙচি চোখমুখ উজ্জ্বল করে বলল, চল, কোন একটা ৱেষ্টুরেন্টে বসে প্ল্যান করি। তোর চেনা-জানা কোন রেস্টুরেন্ট আছে যেখানে বাকি দেবে?
আমি বললাম, তোর ঐ রেস্টুরেষ্টে যাই— কাচ্চি রাসা যেখানে খাস? ব্যাঙচি মুখ করুণ করে বলল, ঐ রেস্টুরেন্ট দুপুরের আগে খুলবে না। পাঁচশ টাকার একটা নোট পকেটে নিয়ে বের হয়েছিলাম। —আরাম করে নাশতা করব। তোর ভাবী পকেট সার্চ করে নিয়ে নিয়েছে। পকেটে ফচ টেপ মারা এক টাকার একটা নোটও নেই। মাঝে মাঝে মনের দুঃখে ভাবি কাক হয়ে কেন জন্মালাম না।
কাক হয়ে জনালে লাভটা কি হত?
মনের সুখে ময়লা খেতাম। ঢাকা শহরে আর যাই হোক ময়লার অভাব নেই।
ব্যাঙচি ফুস করে নিঃশ্বাস ফেলল। আমি তাকে নিয়ে গেলাম বিসমিল্লাহ রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার জোবেদ আলি কোন কারণ ছাড়াই আমার ভক্ত। সে চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে এল। আমি বললাম, জোবেদ আলি সাহেব, গরম গরম পরোটা ভেজে আমার বন্ধুর প্লেটে ফেলতে থাকবেন। পরোটার সঙ্গে কি আছে? পেপে ভাজি বাদ দিয়ে যা আছে সবই দিন। যেটা ভাল লাগবে সেটা বেশি করে নেবে।
রেস্টুরেন্টে মোটামুটি একটা হুড়াহুড়ি পড়ে গেল। ছক্কুর ডিউটি পড়ল আমাদের খাওয়ানো। ব্যাঙচি আমার দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ গলায় বলল, দোস্ত, তুই তো সাধারণ মানব না। মহামানব। আমি খুশি হয়েছি। যা প্রমিজ করলাম— তোর ঐ লোক না পাওয়া পর্যন্ত আমি দাড়ি-গোফ ফেলব না। যদি দাড়ি-গোঁফ ফেলি। তাহলে আমি বাপের ঘরের না। আমি বেজন্মা।
আমি আবারো মুগ্ধ হয়ে ব্যাঙাচির খাওয়া দেখছি। শুধু আমি না, ছক্কু এবং জোবেদ আলিও মুগ্ধ। এত তৃপ্তি নিয়ে যে কেউ খেতে পারে তাই আমার ধারণা ছিল না। মনে হচ্ছে খাওয়ার ব্যাপারটাকে সে উপাসনার পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।
দোস্ত?
খাওয়া শেষ করে তারপর কথা বল।
খেতে খেতেই বলি। খাওয়া শেষ হতে দেরি হবে। তোর ঐ লোক আগে কোথায় থাকত বললি?
অতীশ দীপংকর রোড।
তাহলে আমাদের অনুসন্ধানের সেন্টার হবে অতীশ দীপংকর রোড। ঐ লোক অতীশ দীপংকর রোডের আশপাশেই আছে।
বুঝলি কি করে?
বাড়ি ভাড়া করে যারা বাস করে তারা বাড়ি বদলালেও সেই অঞ্চলেই থাকে, দূরে যায় না। যে ঝিকাতলায় থাকে সে কখনো বাড়ি বদলে কলাবাগানে যাবে না। ঝিকাতলার আশপাশেই ঘুরঘুর করবে।
যুক্তি ভাল।
আমাদের খোঁজ করতে হবে মুদির দোকানে। নাপিতের দোকানে।
চায়ের স্টল?
না, চায়ের ষ্টল না। বাড়ির আশপাশের চায়ের ষ্টলে শুধু ব্যাচেলররা চা খায়। যার ঘর-সংসার আছে সে বাড়ির পাশে চায়ের দোকানে চা খাবে না। সে বউকে বা মেয়েকে চা বানিয়ে দিতে বলবে।
ঐ লোকের বউ বা মেয়ে আছে কি-না তা তো জানি না
তাহলে একটা সমস্যা হয়ে গেল। যাই হোক অসুবিধা হবে না। বিটের পোষ্ট্রম্যানকে ধরতে হবে। এদের স্মৃতিশক্তি ভাল হয়। নাম বলা মাত্র চিনে ফেলতে পারে।
পোষ্টম্যানের কথা আমার একবারও মনে হয়নি।
রেশনের দোকান উঠে গেছে। রেশন শপ থাকলে সমস্যা হত না। ভাল ভাল জিনিসই দেশ থেকে উঠে যাচ্ছে।
ব্যাঙাচির খাওয়া শেষ হয়েছে। সে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে চা দিতে বলল। তার পেটে নিশ্চয়ই এখনো ক্ষিধে আছে। তবে প্ৰবল ক্ষিধের সমস্যা মিটেছে তা বোঝা যায়।
হেভী খেয়েছি দোস্ত। তোর কাছে অন্নখণ হয়ে গেল। যাই হোক ঋণ শোধ করব, চিন্তা করিস না। বিষয়টা নিয়ে সিরিয়াস চিন্তা করছি। অতীশ দীপংকর রোডের পোস্টম্যান হল আমাদের সার্কেলের কেন্দ্ৰবিন্দু। তারপর ধীরে ধীরে সার্কেলটা বড় করব। পাঁচ বছর আগে হলে লিঞ্জী থেকে চট করে বের করে ফেলা যেত। এখন আর যাবে না। ঢাকা শহরে লস্ট্রী নেই। লোকজন এখন আর ধোপাখানায় কাপড় ধোয় না।
এটা তো লক্ষ্য করিনি।
তোর লক্ষ্য না করলেও হবে। আমি করছি। ব্যাটাকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব এখন আমার। তোর অন্নঋণ শোধ দিতে হবে। চল উঠি, একশানে নেমে পড়ি।
যে খাওয়া খেয়েছিস হাঁটতে পারবি তো?
ব্যাঙচি করুণ গলায় বলল, হাঁটতে পারব না দোস্ত। রিকশা নিতে হবে। এখন হাঁটলে আবার ক্ষিধে পেয়ে যাবে। অনেক কষ্টে ক্ষিধেটা চাপা দিয়েছি।
রেস্টুরেন্টে বাকি খাওয়া যায়—বাকিতে রিকশা পাওয়া কষ্টকর ব্যাপার। সম্ভব না। বলেই আমার ধারণা। লিফট পাওয়া গেলে হত। বিদেশে এই সব ক্ষেত্রে বুড়ো আঙ্গুল তুলে লোকজন দাঁড়িয়ে থাকে। কারোর দয়া হলে তুলে নেয়। বাংলাদেশে লিফট প্রথা চালু হয়নি। কার দায় পড়েছে নিজের কেন গাড়িতে অন্যকে চড়ানো।
অবশ্যি এ জাতীয় পরিস্থিতিতে গাড়িওয়ালা মানুষের কাছ থেকে মাঝে মধ্যে আমি উৎসাহব্যঞ্জক সাড়া পেয়েছি। শুধু উৎসাহব্যঞ্জক বললে ভুল হবে, খুবই উৎসাহব্যঞ্জক। একবার উত্তরার কাছে এক পান-সিগারেটের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। রাত একটার মত বাজে। পান-সিগারেটের একটা দোকান খোলা। সেও বন্ধের উপক্রম করছে। হেঁটে হেঁটে ঢাকায় ফিরতে ইচ্ছা করছে না। একটা মিলিটারী জীপ এসে থামল। জীপের ড্রাইভার নেমে এল সিগারেট কিনতে। ড্রাইভারের পাশে বিষণ্ণমুখে যে অফিসারটি বসে আছেন মনে হয় তাঁর জন্যেই সিগারেট কেনা হচ্ছে। অফিসার কোন স্তরের বুঝতে পারছি না। এত বিষণ্ণ কেন তাও বুঝতে পারছি না। যুদ্ধটুদ্ধ হচ্ছে না। বলেই মনে হয় বিষণ্ণ। যুদ্ধ নেই কাজেই কাজও নেই। আমি এগিয়ে গেলাম। তিনি মুখ ফিরিয়ে তাকালেন। আমি বললাম, স্যার আপনার গাড়ির পেছনটা তো ফাঁকা। আপনি কি একজনকে পেছনে বসিয়ে ঢাকা নিয়ে যাবেন? তার খুব উপকার হয়।