বাবা হিমালয়, হিন্দু নারী সম্পর্কে একটি বহুল প্রচলিত লোক-শ্লোক আছে–
পুড়ল কন্যা
উড়ল ছাই
তবেই কন্যার
গুণ গাই।
অর্থাৎ কন্যার দাহকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তার গুণকীর্তন করা যাবে না। মৃত্যুর আগমুহূর্তেও তার পা পিছলাতে পারে। সে ধরা দিতে পারে প্রলোভনের ফাঁদে। পা রাখতে পারে চোরাবালিতে।
এটা শুধু হিন্দু মেয়ে না, সবার জন্যে প্রযোজ্য। এবং তোমার জন্যে বিশেষভাবে প্ৰযোজ্য। মায়া যখন হাতছানি দিবে। তখন তোমাকে রক্ষা করার জন্যে কেউ থাকবে না। মায়াকে মায়া বলে চিনতে হবে। এই চেনাই আসল চেনা।
প্রসঙ্গক্রমে তোমাকে আরেকটি শ্লোক বলি। শ্লোকটি রচনা করেছেন চাক মুনির পুত্র। তাঁর জন্মস্থান তক্ষশিলা। তিনি ছিলেন মহারাজা চন্দ্রগুপ্তের পরামর্শদাতা। যাই হোক, শ্লোকটা এ রকম—
আহার নিদ্ৰা ভয় মৈথুনানি
সমানি চৈতাদি নূনাং পশুনাম।
জ্ঞানী নরানামধিকো বিশেষ্যে।
আহার, নিদ্রা, ভয়, মৈথুন পশু এবং মানুষদের ভেতর সমভাবেই বিদ্যমান। কিন্তু মানুষ জ্ঞানী— আর এখানেই তার বিশিষ্টতা।
চানক্যের এই শ্লোক সব মানুষের জন্যে প্রযোজ্য। কিন্তু তোমার জন্যে নয়। পশু এবং মানুষের ভেতর যা সমভাবে বিদ্যমান তোমাকে তা থেকে আলাদা করার চেষ্টা আমি করেছি। কতটুকু সফল হয়েছি। আমি জানি না। তবে আমার ধারণা—আমার সারাজীবনের সাধনা বিফলে যাবে না। তুমি সন্ধান পাবে পরম আরাধ্যের।
আমার নিজের ধারণা বাবার সাধনা বিফলেই গেছে। তাঁর পুত্র বর্তমানে পরম আরাধ্যের সন্ধান করছে না। সন্ধান করছে— ইয়াকুবের।
আমি হাত-মুখ ধুতে গেলাম। আজ অনেকগুলি কাজ করতে হবে। ব্যাঙচিকে খুঁজে বের করতে হবে। ব্যাঙচিকে নিয়ে শুরু হবে অভিযান–
In search of Yakub.
যে কোন অনুসন্ধানেই দুজন থাকলে ভাল হয়। হিমালয়ে হিলারী এক উঠেননি, সঙ্গে ছিল তেনজিং।
দরজায় টকটক শব্দ হচ্ছে। তামান্না ফিরে এল না-কি? আমি আগ্রহ নিয়ে বললাম, কে?
ছক্কু গলা বের করল। সে কোকের বোতল ভর্তি করে চা নিয়ে এসেছে। সিগন্যাল না দিতেই চা নিয়ে এল ব্যাপার কি?
কি খবর ছক্কু?
জ্বে খবর ভাল।
ছক্কু চায়ের বোতল নামিয়ে রাখল। পরোটা ভাজির বাটি সাজাতে বসল। আজ দেখি পরোটা ভাজির সঙ্গে ডিমের ওমলেট উঁকি দিচ্ছে। এইখানেই শেষ না। আরেকটা বাটিতে ঝোল জাতীয় কিছু। সেখানে মুরগির ডানার হাড় ডুব দিয়ে আছে। আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ব্যাপার কিরে?
ব্যাপার কিছুনা।
তুই দেখি রাজাবাদশার খাবার নিয়ে এসেছিস। করেছিস কি? দুটাকা হল আমার নাশতার বাজেট। পরোটা ভাজি রেখে বাকি সব ফিরিয়ে নিয়ে যা।
ছক্কু লজ্জিত মুখে বলল, খান। আইজের খানা ফিরি।
ফিরি কেন?
আইজ আমি খাওয়াইতেছি।
ভাল। বোলের মত ঐ জিনিসটা কি?
ছুপ। মুরগির ছুপ।
হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসলাম। পরোটা ছিঁড়ে মুরগির ছুপে ভিজিয়ে খাচ্ছি। ছক্কু আনন্দিত চোখে আমাকে দেখছে। পরোটাগুলি আগুন গরম। ছুপ জিনিসটা দেখতে কুৎসিত হলেও খেতে ভাল। আমি তৃপ্তি করে খেলাম। খাওয়া শেষ করে বললাম, খেয়ে আরাম পেয়েছিরে ছক্কু। এখন বল কি চাস? ঝটপট বলতে হবে। যা চাইবি তাই পাবি। কি চাস তুই?
ছক্কু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। কিছু বলতে পারছে না। আমি চায়ের কাপে চা ঢালতে ঢালতে বললাম, আশ্চর্য এ রকম একটা সুযোগ মিস করলি। মুখ ফুটে কিছু চাইতে পারলি না।
ছক্কু মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত তার ধারণা হয়েছে সে বিরাট সুযোগ হেলায় হারিয়েছে।
তোর কিছু চাইবার নেই?
আছে।
সেটা কি?
একটা দোকান দিতে ইচ্ছা করে।
চায়ের দোকান?
জ্বি না ইষ্টিশন দোকান।
ষ্টেশনারী দোকান?
জ্বে। নানান পদের বাজে মাল থাকব।
ভুল করলি, তোরে ব্যাটা যখন চাইবার তখন চাইলি না।
এমন সুযোগ আর আসব না?
সুযোগ তো বার বার আসে না। হঠাৎ হঠাৎ আসে-
মনে হচ্ছে সে কেঁদে ফেলবে। কাঁদুক। মানুষ হয়ে যখন জন্মেছে তখন কাঁদতে তো হবেই।
মেসের ম্যানেজার খবর পাঠিয়েছে
মেসের ম্যানেজার খবর পাঠিয়েছে — রুলটানা কাগজে পেনসিলে লেখা — মোটা এক আদমী দেখা করতে এসেছে। সিড়ি ভেঙ্গে দোতলায় উঠবে না। তাঁর ঘরে বসে। আছে। লোকটাকে ভাল মনে হচ্ছে না। এখন কি করণীয়?
আমি নিচে নেমে দেখি ব্যাঙাচি। গভীর মনোযোগে বাসি। খবরের কাগজ পড়ছে। ব্যাঙচিকে আজ আরো মোট লাগছে। তার গায়ের শার্টটা জমকাল। লাল নীল ফুল লতা পাতা সাপ খোপ আকা। সাহেবরা হাওয়াই দ্বীপ বেড়াতে গেলে এ রকম শার্ট পরে। তাদের বগলে থাকে রোগা পটকা মেয়ে। যে সাহেব যত মোটা তার বগলের তরুণী ততই রোগা। রোগা পাটকাদের এ রকম শার্ট মানায় না।
ব্যাঙচি আমাকে দেখে মুখ ভর্তি করে হাসল। আমি বললাম, নাশতা খেয়ে বের হয়েছিস?
হুঁ।
কি নাশতা? পরোটা কটা ছিল?
পরোটা না। আটার রুটি। দেড় পিস রুটি।
বলিস কি? রুটির সঙ্গে কি?
পাঁপে ভাজি। আধা কাপ কমলার রস।
ব্যাস আর কিছু না?
দোস্ত আর কিছু না। তোর ভাবী আমাকে খেতে দেয় না। তার ধারণা খেতে না। দিলে আমি বোধহয় আগের মত হয়ে যাব।
না খেলেও তুই ফুলতে থাকিবি?
অবশ্যই। এখন একবার ওজন নে। না খাইয়ে সাতদিন একটা ঘরে বন্দি করে। রাখা। সাত দিন পর ওজন নে, দেখবি ওয়েট এগারো কেজি বেড়েছে।
সর্বনাশ!
সারাক্ষণ পেটে ক্ষুধা নিয়ে ঘুরি, দোস্ত। ক্ষুধা কমে না। আমার জীবনের একটা শখ কি জানিস দোস্ত। একটাই শখ মনের তৃপ্তিতে একবেলা খাব। ক্ষিধে না মেটা পর্যন্ত খেয়েই যাব। মানুষের নানা রকম ভাল ভাল স্বপ্ন থাকে-আমার এই একটাই স্বপ্ন। জানি না। স্বপ্ন সত্যি হবে কিনা।