চিঠি শেষ করে আমি তামান্নার দিকে তাকালাম। সে আগের মতই মিটি মিটি করে। হাসছে। এখন মাথা থেকে স্কাফ খুলে ফেলেছে। স্কাফ খোলার জন্যে তাকে আরো সুন্দর লাগছে। তার মাথা ভর্তি ফুলানো-ফ্যাপানো চুল। তামান্না যদি ছেলে হত তাহলে নাপিতরা তার চুল কেটে খুব মজা পেত। গোছা গোছা চুল কাটা হবে। শব্দ হবে কচকচ কচকচ।
আমি বললাম, আপনি চিঠিটা পড়েছেন তাই না?
তামান্না হকচকিয়ে গিয়ে বলল, জ্বি। দয়া করে ম্যাডামকে কিছু বলবেন না। ম্যাডাম বিশ্বাস করে এই চিঠি আমার হাতে পাঠিয়েছেন। আমি বিশ্বাসভঙ্গের কারণ হয়েছি।
পড়লেন কেন?
ম্যােডামের সব চিঠিপত্র আসলে আমি লিখে দেই। উনি শুধু সই করেন। এই চিঠিটা উনি নিজে অনেক সময় নিয়ে লিখলেন। নিজেই খামে মুখ বন্ধ করলেন। খামের মুখ ঠিকমত বন্ধ হয়েছে কি-না নানানভাবে পরীক্ষা করলেন। এতে আমার কৌতূহল খুব বেড়ে গেল। এবং কি জন্যে জানি আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে গেলাম চিঠিটায় আমার প্রসঙ্গে লেখা আছে। সেই কারণেই খুলে পড়েছি। আমার মস্ত বড় ভুল হয়েছে। আমি খুবই লজ্জিত।
চা খাবেন?
জ্বি না, চা খাব না।
কফি খাবেন?
তামান্না তাকিয়ে রইল। আমি বললাম, খালা আপনার প্রতি এটেনশন দিতে বলেছেন এই জন্যেই চা-কফির কথা জিজ্ঞেস করছি।
জ্বি না, কফিও খাব না।
ঠাণ্ডা কিছু পেপসি বা কোক কিংবা লাচ্ছি?
তামান্না হেসে ফেলল। শব্দ করে হাসি। হেসেই বোধহয় তার মনে হল হাসা ঠিক হয়নি। সে গভীর হতে চেষ্টা করল। মানুষের চরিত্রে তরল ভােব চলে এলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে কঠিন করা সহজসাধ্য না। মেয়েটা গম্ভীর হতে চেষ্টা করছে, পারছে না। আমি বললাম, আপনি বসুন আমি হাতমুখ ধুয়ে আসি। তারপর চলুন বোটানিকেল গার্ডেন দেখে আসি। না-কি চন্দ্রিমা উদ্যানে যেতে চান? বিবাহপূর্ব প্রেমের জন্যে চন্দ্রিমা উদ্যান ভাল।
তামান্না আবারো হেসে উঠল। মেয়েটা ভাল হাসতে পারে। কিংবা এও হতে পারে। যে, সে যে পরিবেশে বাস করে সেখানে হাসার সুযোগ তেমন নেই। অনেকদিন পর মন খুলে হাসতে পারছে।
তামান্না এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম, চা দিতে বলি চা খান?
জ্বি আচ্ছা।
তিন মিনিট চোখ বন্ধ করে থাকতে পারবেন?
তামান্না অবাক হয়ে বলল, চোখ বন্ধ করতে হবে কেন?
আমি খালি গায়ে লেপের ভেতর বসে আছি। চোখটা বন্ধ করলে লেপটা ফেলে দিয়ে শার্ট গায়ে দিতে পারি। সুন্দরী একটা মেয়ের সামনে খালি গা হওয়া অসম্ভব ব্যাপার।
আমি আজ চলে যাই, আরেকদিন এসে চা খাব।
আচ্ছা ঠিক আছে।
তামান্না উঠে দাঁড়াল। মাথায় স্কাফ পরল। আবার বসে পড়ল। সে মনে হয়। গুরুত্বপূর্ণ কোন কথা বলবে। সিরিয়াস ধরনের কোন কথা। ছেলেরা হুটহাট করে সিরিয়াস কথা বলে ফেলতে পারে। মেয়েরা পারে না। তাদের সিরিয়াস কথা বলার জন্যে সামান্য হলেও আয়োজন লাগে। তামান্না সেই আয়োজন করছে। কি বলবে তা আমি মনে হচ্ছে আন্দাজ করতে পারছি।
হিমু সাহেব।
জ্বি।
ম্যাডাম আপনার সম্পর্কে আমাকে অনেক ভাল ভাল কথা বলেছেন। আমি ম্যাডামের কথা যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। ধরে নিচ্ছি। উনি সত্যি কথাই বলছেন। কিন্তু…
আমাকে বিয়ে করা আপনার পক্ষে সম্ভব না, তাই তো?
।জ্বি।
আমাকে বিয়ে দেবার দায়িত্ব ম্যাডামকে দেয়া হয়নি। উনি আগবাড়িয়ে সেই দায়িত্ব কেন নিতে চাচ্ছেন তাও জানি না। বিয়ে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত একটা ব্যাপার। উনি কেন আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাবেন?
আমি কি খালাকে নিষেধ করে দেব?
না। ম্যাডাম বিরক্ত হবেন। আমি কিছুতেই ম্যাডামকে বিরক্ত করতে চাই না। উনার মতের বাইরে গেলেই আমার চাকরি চলে যাবে। ভাই-বোন নিয়ে আমি পথে বসব। কি যে করব কিছু বুঝতে পারছি না।
আমি একটা পরামর্শ দেই?
দিন।
মনে করুন। আপনি হাওড়ের মাঝখানে নীেকা নিয়ে আছেন। দুর্ঘটনায় আপনার হাত থেকে বৈঠা পড়ে গেছে। আপনার নৌকায় পাল ছাড়া কিছু নেই। এই অবস্থায় আপনার প্রধান কর্তব্য হচ্ছে হাওড় পাড়ি দেয়া। কোথায় গিয়ে ঠেকবে সেটা বড় কথা নয়। হাওড় পাড়ি দেয়া বড় কথা। কাজেই আপনাকে যে দিকে হাওয়া সেদিকে পাল দিতে হবে। আপনার ম্যাডাম হচ্ছেন হাওয়া, হাওয়া যেদিকে বইছে সেই দিকে পাল তুলে দিন।
আপনাকে বিয়ে করতে বলছেন?
তা বলছি না। খালার সব কথায় সায় দিয়ে শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে যাবেন। বিয়ের পিড়তে বসে হঠাৎ বলবেন — একটু বাথরুমে যেতে হবে। এই বলে পগার পার।
রসিকতা করছেন?
মোটেই রসিকতা করছি না। বিয়ে নিয়ে একটা পাতানো খেলা খেলতে আমি রাজি আছি।
তামান্না উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আপনাকে কোন কিছুতে রাজিও হতে হবে না, অরাজিও হতে হবে না। আমি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী একটা মেয়ে। আমার সমস্যার সমাধান সবসময় আমি নিজে করেছি, এখনো তাই করব।
জ্বি আচ্ছা।
আপনি শুধু দয়া করে এখন আপনার সঙ্গে যেসব কথা হল তা খালাকে বলবেন না।
জ্বি আচ্ছা।
তামান্না ক্লান্ত ভঙ্গিতে চলে গেল। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম মেয়েটার উপর রাগ হচ্ছে।
অথচ রাগ লাগার তো কোন কারণ নেই। আমার অবচেতন মন কি চাচ্ছিল—এই মেয়েটির সঙ্গে আমার ভাব হোক? হাসিঠাট্টা করে বললেও কি মনের একটি অংশ সত্যি সত্যি চাচ্ছে যে তাকে নিয়ে আমি চন্দ্ৰিমা উদ্যানে হাঁটতে বের হই।
আমার বাবা তার পুত্রের জন্যে লিখিতভাবে যে উপদেশমালা রেখে গেছেন সেখানে বারবার আমাকে একটি ব্যাপারেই সাবধান করা হয়েছে–