আমার যদি ঘুম ভেঙ্গে না যেত আমি নিশ্চিত সে মেঝে থেকে লেপ তুলে আমার গায়ে দিয়ে দিত। মাথার নিচের বালিশ ঠিকঠাক করে দিত। আমি দ্রুত চিন্তা করার চেষ্টা করছি— মেয়েটা কে হতে পারে? নিশ্চয়ই আমার পরিচিত। পরিচিত না হলে ঘরে ঢুকবে না। দরজা খোলা থাকলেও উঁকি দিয়ে দেখেই দরজায় টোকা দেবে। ঘরের বাইরে থেকে সাড়াশব্দ করে ঘুম ভাঙ্গাবার চেষ্টা করবে। মেয়েদের সম্পর্কে সবার ধারণা তারা খুব ধৈর্যশীলা। আসলে তা না। মেয়েরা ধৈর্য ধরে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে পারে। না। বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছেলেরা যেখানে দু তিনবার কলিং বেল টিপবে— মেয়েরা সেখানে কলিং বেল টিপে যেতেই থাকবে।
মেয়েটি হাসিমুখে বলল, আপনি বোধহয় আমাকে দেখে খুবই বিস্মিত হচ্ছেন। ভাবছেন কে-না কে? অভদ্রের মত ঘুমন্ত মানুষের ঘরে বসে আছে।
আমি লেপ দিয়ে গা ঢাকতে ঢাকতে বললাম, আমি মোটেই বিস্মিত হচ্ছি না।
আপনাকে দেখে ভাল লাগছে।
অপরিচিত একজন মানুষ ঘরে ঢুকে বসে আছে, তারপরেও বিস্মিত হচ্ছেন না?
না। কারণ আপনি মোটেই অপরিচিত নন— আপনি হলেন তামান্না। ফাতেমা খালার পি.এ.।
মেয়েটা নিজেই এবার বিস্মিত হয়ে বলল, বুঝলেন কি করে?
আমার আধ্যাত্মিক ক্ষমতা আছে। সেই ক্ষমতা দিয়ে টের পাচ্ছি। খালা আপনাকে আমার অলৌকিক ক্ষমতা সম্পর্কে কিছু বলেনি?
বলেছেন।
আপনি বিশ্বাস করেননি?
জ্বি-না।
এখন কি করছেন?
এখনো করছি না। আপনি অনুমান করে বলেছেন আমি তামান্না। এমন কোন জটিল অনুমানও না। সহজ অংক। দুই দুই-এ চার।
ঠিক বলেছেন। আমার নিজেরো ধারণা আমার কোন ক্ষমতা নেই। তবে অনেকের ধারণা খুব প্রবলভাবেই আছে। আপনার ম্যাডাম অর্থাৎ ফাতেমা খালা তাদের মধ্যে একজন।
আমি ম্যাডামের একটা চিঠি নিয়ে এসেছি।
আপনাকে পাঠালো কেন? খালার টাই পরা ম্যানেজার কোথায়, বুলবুল ভাইয়া?
উনি আছেন। তারপরেও আমাকে পাঠিয়েছেন। নিশ্চয়ই কোন একটা উদ্দেশ্য আছে। যাই হোক, এই নিন। চিঠি। আপনি চিঠি পড়ুন, আমি চললাম।
চিঠি শেষ না হওয়া পর্যন্ত বসুন। হয়ত চিঠিতে জরুরী কিছু আছে। আপনাকে দিয়েই জবাব পাঠাতে হবে।
আচ্ছা। আপনি চিঠি পড়ুন, আমি বসছি। আপনি কি দরজা খােলা রেখে ঘুমান? চোর ঢুকে না?
চুকে। আমার ঘরের জিনিসপত্র দেখে লজ্জা পেয়ে চলে যায়। চোরদেরও কিন্তু চক্ষু লজ্জা আছে।
ঘর খোলা রেখে ঘুমান কেন? চোরদের লজ্জা দেবার জন্যে?
তা না। আমার বাবা আমাকে খোলা মাঠে ঘুমুতে বলেছেন। খোলা মাঠের বিকল্প হিসেবে খোলা ঘর।
আমি চিঠি পড়া শুরু করেছি। তামান্না আড়চোখে আমাকে দেখছে। মনে হচ্ছে আমার চিঠি পড়া দেখে সে মজা পাচ্ছে। খালা তাঁর দুর্বোধ্য হাতের লেখায় লিখেছেন—
হিমু,
তুই যে গেলি আর তো দেখা নেই। একদিন শুধু টেলিফোনে হড়বড় করে কিসব বললি। মাথার যন্ত্রণায় সব বুঝতেও পারলাম না। ইয়াকুবকে খোঁজার ব্যাপারে কি করছিস আমাকে জানাবি না? না-কি ভুলেই গেছিস যে, তোকে একটা দায়িত্ব দিয়েছি? তোর চশমা, চাদর, নতুন পাঞ্জাবী সব তো ফেলে গেলি।
ঐদিন একটা ভুলও করেছি — ইয়াকুবকে খুঁজে বের করার জন্যে তোকে কিছু খরচ দেব বলে ভেবে রেখেছিলাম। সেদিন যাবার সময় তুই এমন তাড়াহুড়া শুরু করলি যে খরচ দেবার কথাটাই মাথা থেকে দূর হয়ে গেল।
তুই রবি সোম এই দুদিন বাদ দিয়ে যে কোন একদিন চলে আয়। ম্যানেজারকে না পাঠিয়ে ইচ্ছে করে তামান্নাকে পাঠালাম। যাতে তোর সঙ্গে পরিচয় হয়। কৌশলটা ভাল করিনি? মেয়েটাকে নিশ্চয়ই তোর পছন্দ হয়েছে। পছন্দ হবার মতই মেয়ে। দেখতেও খুব সুন্দর তাই না? রঙটা শুধু যদি আর এক পোছ সাদা হত তাহলে আর চোখ ফেরানো যেত না। মেয়েটা যে এত সুন্দর এটা তোকে ইচ্ছে করেই আগে জানাইনি। বরং ইচ্ছা করে বলেছি মেয়েটা ডাউন টাইপ। আগে জানিয়ে রাখলে তুই কল্পনায় উর্বশী বা মেনকা ভেবে রাখতি। তখন আর তামান্নাকে এখন যত সুন্দর লাগছে তত সুন্দর লাগত না।
হিমু, তোকে আল্লার দোহাই লাগে তুই এমন কিছু করিস না। যেন মেয়েটা চিরদিনের জন্যে তোর প্রতি বিরূপ হয়ে যায়। তোর আচার-আচরণ, কথাবার্তা কিছুই ভাল না। তোর টাইপের ছেলেদের কাছ থেকে মেয়ের একশ হাত দূরে থাকে। কাজেই ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও মেয়েরা যেসব আচরণ পছন্দ করে সে রকম আচরণ করবি।
আমি রিডার্স ডাইজেষ্টে পড়েছি মেয়েরা এটেনশন খুব পছন্দ করে। তুই এমন ভাব করবি যেন তামান্নার ধারণা হয় তুই তার দিকে খুব এটেনশান দিচ্ছিস। তোর ফাজলামি ধরনের রসিকতাগুলি অবশ্যই করবি না। মেয়েরা রসিকতা পছন্দ করে না। এটাও রিডার্স ডাইজেষ্টে পড়েছি। মেয়েরা সিরিয়াস টাইপ পুরুষ পছন্দ করে। যারা রসিকতা করে মেয়েরা তাকে ছ্যাবলা ভাবে।
আমি যা বলছি তোর ভালর জন্যেই বলছি। তোর তোকে খুব পছন্দ করতো। এই জন্যেই তোর জন্যে আমার কিছু করতে ইচ্ছে করে, যদিও খুব ভাল করেই জানি যে মেয়ের সঙ্গে তোর বিয়ে হবে তার জীবনটা ছারখার হয়ে যাবে।
তুই ভাল থাকিস। ইয়াকুবের ব্যাপারটা মনে রাখবি। আমি খুব টেনশনে আছি। ঐ ব্যাটার কথা ভাবতে ভাবতে আমার পেটে গ্যাস হচ্ছে। গ্যাসের চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাব। সিঙ্গাপুরে আমেরিকান হসপিটালটা নাকি খুব ভাল। আরেকটা হসপিটাল আছে এলিজাবেথ হসপিটাল। দুটার একটায় যাব। এখনো ফাইনাল করিনি। আচ্ছা হিমু শোন, তুই কি আমার সঙ্গে যাবি? তুই তো দেশের বাইরে কখনো যাসনি। এই ফাঁকে বিদেশ দেখা হল। আমি ঠিক করে রেখেছি তামান্নাকে সঙ্গে নিয়ে যাব। তুই যদি সঙ্গে থাকিস তাহলে ভালই হয়, মাঝে মধ্যে তামান্নাকে নিয়ে শপিংএ গেলি। বা দুজনে মিলে ছবি দেখলি। এইভাবেও মেয়েটার সঙ্গে তোর ভাব হতে পারে। যাই হোক, অনেক কথা লিখে ফেললাম। ভাল থাকিস।
তোর ফাতেমা খালা।