মেছকান্দর আমাকে দেখে বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকাল। আমি মধুর গলায় বললাম, কেমন আছ মেছকান্দর?
সে জবাব দিল না। পিচ করে থুথু ফেলল। থুথু পড়ল পাথরটার উপর।
আমি বললাম, মেছকান্দর আজ হল ২১ তারিখ। তুমি তারিখ জানতে চাও। কাজেই আমি ঠিক করেছি। রোজ এসে তোমাকে তারিখ জানিয়ে যাব।
মেছকাব্দর এক চোখে তাকিয়ে আছে। এক চোখের দৃষ্টি এমনিতেই তীক্ষ্ণ হয়। আজ আরো তীক্ষা লাগছে। মেছকান্দর বিড়ি বের করে ধরাল। আমি অমায়িক গলায় বললাম, আমাকে একটা বিড়ি দাও তো।
মেছকান্দর বিরক্ত গলায় বলল, ক্যান আমারে ত্যাক্ত করতেছেন? আমি আপনের কি ক্ষতি করছি?
বলতে বলতে সে পাথরের উপর আবার থুথু ফেলল। আমি বললাম, পাথরের উপর থুথু ফেলো না। আমি ঠিক করেছি। এই পাথরটা আমি আমার এক বন্ধুকে উপহার দেব। সে সর্বভুক। হাতুড়ি দিয়ে পাথর ভেঙ্গে টুকরা টুকরা করে সে খেয়ে ফেলবে। একটু সিরকা দেবে, কিছু লবণ, কিছু গোলমরিচ। পাথরের চাটনি।
মেছকান্দর কঠিন চোখে তাকিয়ে আছে। তার হাতের বিড়ি নিভে গেছে। কিন্তু চোখে আগুন জ্বলছে। আমি পাথরের উপর বসে পড়লাম। সন্ধ্যা হচ্ছে। পাথরে বসে। সন্ধ্যার দৃশ্য দেখতে ভাল লাগার কথা। মেছকান্দরের মুখ ভর্তি থুথু মনে হচ্ছে পাথরটা সে ব্যবহার করে থুথু ফেলার জন্যে। আমি পাথরে বসে থাকায় সে থুথু ফেলতে পারছে
আমি ইয়াকুব সাহেবকে স্বপ্নে দেখলাম
আমি ইয়াকুব সাহেবকে স্বপ্নে দেখলাম। ভদ্রলোকের কেমন মমি মমি চেহারা। তাঁর চোখেও কোন সমস্যা আছে। সারাক্ষণ পিটপিট করে চোখের পাতা ফেলছেন। শবাসনের মত শিরদাঁড়া সোজা করে আমার বিছানায় বসে আছেন। খালি গা, গা বেয়ে ঘাম পড়ছে। অথচ শীতকাল। আমি চাদর গায়েই স্বপ্নের ভেতর কাঁপিছি। ইয়াকুব সাহেব মাঝে মাঝে বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। খালি গায়ের কারণে তাঁর পাঁজরের সব হাড় দেখা যাচ্ছে। পাঁজর বের করা বুদ্ধের মূর্তির সঙ্গে কিছু মিল আছে। বুদ্ধদেবের কানের মত বড় বড় কান টান টান চোখ।
আমি বললাম, ইয়াকুব সাহেব না?
তিনি বললেন, জ্বি জনাব। আমার নাম ইয়াকুব।
আপনাকে কদিন ধরেই খুজে বেড়াচ্ছি। কেমন আছেন?
জ্বি ভাল।
ধ্যান করছিলেন নাকি?
অনেকটা সে রকমই।
সরি, আপনার ধ্যান ভাঙ্গালাম।
না, ঠিক আছে।
আপনি আসল ইয়াকুব তো? আপনার বাবার নাম কি?
বাবার নাম শ্ৰী সোলায়মান।
নামের আগে শ্রী বসাচ্ছেন কেন? আপনি মুসলমান না?
জ্বি না। আমাদের মানব ধর্ম।
ও আচ্ছা, মানব ধর্ম। মানব ধর্মে নামের আগে শ্ৰী বসানো যায়, আবার জনাবও বসানো যায়। আপনার যা ভাল লাগে। তাই বসাতে পারেন।
জানতাম না।
ইয়াকুব সাহেব ধ্যানস্ত হয়ে পড়লেন। চোখ বন্ধ। আমি ইতস্তত করে বললাম, ধ্যান করে কিছু পাচ্ছেন?
কিছু পাওয়ার জন্যে তো ধ্যান করছি না। মনের শান্তির জন্যে ধ্যান করছি।
শান্তি পাচ্ছেন?
এখনো পাচ্ছি না, তবে পাব।
ইয়াকুব সাহেব!
জ্বি।
আপনার ঠাণ্ডা লাগছে না?
জ্বি। একটু লাগছে।
আমার চাদরটা কি আপনার গায়ে জড়িয়ে দেব?
দিতে পারেন। তবে আপনার তো ঠাণ্ডা লাগবে।
ঠাণ্ডায় আমার কষ্ট হয় না। ঠাণ্ডা সহ্য করার মন্ত্র আমাকে আমার বাবা শিখিয়ে গেছেন।
মন্ত্রটা কি?
আপনাকে বলা যাবে না। গুরুমুখী গুপ্ত বিদ্যা। আপনাকে বললেই বিদ্যা চলে যাবে।
তাহলে বলার দরকার নেই। চাদরটা গায়ে জড়িয়ে দিন। ভাল ঠাণ্ডা পড়েছে।
এত ঠাণ্ডা জানলে খালি গায়ে ধ্যানে বসতাম না। মিসটেক হয়ে গেছে।
আমি ইয়াকুব সাহেবের গায়ে চাদর জড়িয়ে দিলাম। স্বপ্নের মধ্যেই শীতে আমার নিজের শরীর জমে গেল এবং আমি জেগে উঠে দেখি গায়ের লেপ মেঝেতে পড়ে আছে। আমি ঠিকঠক করে কাঁপছি। এ বছর আবহাওয়ার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। কদিন আগেই গরম ছিল –এখন আবার শীত নেমে গেছে। ভয়াবহ শীত। শৈত্য প্রবাহ চলছে। খবরের কাগজ বলছে এক সপ্তাহ থাকবে। নেতাদের খুব সুবিধা হয়েছে। করুণ মুখ করে—সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনেলে, গাবতলীতে, কমলাপুর রেল স্টেশনে শীতের কাপড় বিলি করতে পারছেন। সেই ছবি টিভিতে দেখানো হচ্ছে। পত্রিকায় সচিত্র সংবাদ ছাপা হচ্ছে। ছবির ক্যাপশান—
শীতার্ত মায়ের মুখে হাসি
দেখা যাচ্ছে মা একজন খালি গায়ের শিশুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মা এবং শিশু দুজনের মুখ ভর্তি হাসি। দুজনই কম্বলের দিকে হাত বাড়িয়ে আছে।
সবাই খুশি। নেতা খুশি তিনি কম্বল দেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। মা এবং শিশু খুশি তারা কম্বল পাচ্ছে। ফটোগ্রাফার খুশি দারুণ একটা ছবি তোলা গেল।
মেঝে থেকে লেপ তুলতে গিয়ে আমি ছোটখাট একটা শকের মত পেলাম। আমার ঘরে বাইশ-তেইশ বছরের একটা মেয়ে। পায়ের কাছের চেয়ারে চুপচাপ বসে আছে। মেয়েটা প্রিন্টের একটা শাড়ি পরেছে। শীতের জন্যে মাথায় স্কাফ বাঁধা। মেয়েটিকে সুন্দর দেখাচ্ছে বললে ভুল হবে— অপূর্ব লাগছে বললেও কম বলা হয়। স্বপ্ন দৃশ্যের মেয়েরাই এত সুন্দর হয়। একটু আগে স্বপ্নে ইয়াকুবকে দেখেছি— এই মেয়েটিকেও স্বপ্ন দেখছি না তো। আজ বোধহয় আমার স্বপ্ন দেখার দিন। না। স্বপ্ন না, মেয়েটির গা থেকে সেন্টের গন্ধ আসছে। স্বপ্ন দৃশ্যে গন্ধ থাকে না। মেয়েটার চোখ ভর্তি বিস্ময়। ঠোঁট চেপে সে হাসছে। ঘুমের মধ্যে আমি হাস্যকর কোন কাণ্ড করেছি কি-না কে জানে।
শান্ত চেহারার মেয়ে। নিশ্চয়ই কোন বাড়ির বড় মেয়ে, যার অনেকগুলি ছোট ছোট ভাই-বোন আছে। ভাই-বোনগুলি দুষ্ট। এদের সবাইকে সামলো-সুমলে রাখতে হয়। এ ধরনের বাড়ির বড় মেয়েদের চেহারা এ রকম হয়। এরা মেয়ে হিসেবে খুবই ভাল, শুধু সমস্যা একটাই— এরা সবাইকে ছোট ভাইবোনের মত দেখে।