প্ৰশ্নকর্তা বিষণ্ণ গলায় বলল, কেউ আমাকে চিনতে পারে না। তাদের দোষ দিয়ে কি হবে। আমি নিজেই নিজেকে চিনি না। তোর সঙ্গে কিশোর মোহন পাঠশালায় পড়তাম। আমি আরিফ। আরিফুল আলম জোয়ার্দার। এখনো চিনতে পারিসনি?
না।
চেনা চেনা কি লাগছে? না তাও লাগছে না?
তাও লাগছে না। অবশ্য শুরুতে ভেবেছিলাম—তুই ইয়াকুব।
ইয়াকুব কে?
ইয়াকুব হল সোলায়মানের ছেলে। সোলায়মানটা কে?
বাদ দে, চিনতে পারবি না। কেমন আছিস বল?
দোস্ত সত্যি করে বল তুই এখনো আমাকে চিনতে পারছিস না?
না।
চিনতে না পারলে এমন আন্তরিকভাবে কথা বলছিস কেন?
তুই আন্তরিকভাবে কথা বলছিস দেখে আমিও বলছি।
আরিফূল আলম জোয়ার্দার গলা নিচু করে বলল, ক্লাস ফোরে পড়ার সময় একদিন বেঞ্চিতে ইয়ে করেছিলাম। যার জন্যে টিফিনের সময় ক্লাস ছুটি হয়ে গেল। অংক স্যার আমাকে ডাকতেন — ব্যাঙচি।
আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি, ব্যাঙাচির এই অবস্থা?
ইউনিভার্সিটির পুরানো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে মুখ হাসি হাসি করে জিজ্ঞেস করা হয়— তারপর কি খবর ভাল আছেন? এখন কি করছেন? কলেজের পুরানো বন্ধুর সঙ্গে বলা হয়— আরো তুমি? কেমন আছ? আর স্কুল লেভেলের বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে— একজন আরেকজনের উপর ঝাপিয়ে পড়ে –তাই নিয়ম।
আমি ব্যাঙাচির উপর ঝাঁপ দেব কি দেব না ভাবছি। বেচারা যেভাবে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে মনে হচ্ছে আমার ঝাঁপের অপেক্ষা করছে। ঝাঁপ দেয়াই মনস্থ করলাম।
দুহাতেও তাকে ঠিক জড়িয়ে ধরা গেল না। ব্যাঙচি ধরা গলায় বলল, দোস্ত গরমের মধ্যে জড়াজড়ি করিস না ছাড়। শরীর ভর্তি চর্বি। জড়াজড়ি করলে অস্বস্তি লাগে।
আমি বললাম, লাণ্ডক অস্বস্তি। তোকে ছাড়ব না। তুই এমন মটু হয়েছিস কি ভাবে?
খেয়ে খেয়ে মটু হয়েছি দোস্ত। দিন-রাত খাই।
বলিস কি?
কেন খাব না বল— আল্লাহপাক মানুষকে খাওয়ার জন্যেই তো সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই মানুষের খাদ্যদ্রব্য। গরু-মহিষ, ছাগলভেড়া, পোকামাকড়, গাছ-গাছড়া সবই তো আমরা খাচ্ছি। খাচ্ছি না?
হুঁ খচ্ছি।
আমার এক চাচী ছিলেন পেটে সন্তান এলেই তিনি মাটি খেতেন। মাটির চুলার তিনটা মাথা ভেঙ্গে একদিন খেয়ে ফেললেন। সেদিন রান্না হল না। রাঁধবে কোথায়? চুলা নেই। চাচীর শাশুড়ি চাচীর উপর খুব রাগ করল—বৌমা এতই যদি মাটি খেতে হয়— ক্ষেতে চলে যাও। ক্ষেতে গিয়ে মাটি খাও। আমি চোখের আড়াল হলে তুমি দেখি বাড়িঘর সব খেয়ে ফেলবে। তাদের আবার মাটির ঘরবাড়ি তো, এই জন্যে চিন্তাটা বেশি।
আমি হো হো করে হাসছি। বড় হয়ে ব্যাঙচি যে এমন রসিক হবে তা বোঝা যায়নি। ছোটবেলায় তার প্রতিভা বেঞ্চিতে ইয়ে করে দেবার ব্যাপারেই সীমাবদ্ধ ছিল।
ব্যাঙচি ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তোর সঙ্গে দেখা হয়ে ভাল লাগছে রে দোস্ত। তুই যখন জড়িয়ে ধরলি তখন প্রায় কেঁদেই ফেলেছিলাম। দেখা হলে জড়িয়ে ধরার মত বন্ধু মানুষের এক দুটার বেশি থাকে না। আয় কোথাও বসে চা-টা কিছু খাই। ভাল কথা, চাকরি-বাকরি কিছু করছিস?
পার্ট টাইম চাকরি।
পার্ট টাইম চাকরি ভাল রে দোস্ত। টেনশান কম। কাজটা কি? বেতন কত? বেতন কম হলে বলিস না। তোকে লজ্জা দেবার জন্যে জিজ্ঞেস করিনি। পুরানো বন্ধু সেই দাবিতে জিজ্ঞেস করা।
অনুসন্ধানের কাজ। একটা লোককে খুজে বের করা। খুজে বের করতে পারলে কুড়ি হাজার টাকা পাব। খুঁজে না পেলে লবডঙ্গা।
দোস্ত চিন্তা করিস না। আমি তোকে সাহায্য করব। ওয়ার্ড অব অনার। পুরানো বন্ধুর জন্যে এইটুকু না করলে কি হয়। তাছাড়া আমার কাজকর্মও কিছু নেই। আয় কোথাও বসে চা-টা কিছু খাই। ফর ওল্ড টাইম সেক। তোর সঙ্গে টাকা-পয়সা কিছু
আছে?
না। আমার পাঞ্জাবীর পকেট নেই।
এটা ভাল করেছিস। পকেটই ফেলে দিয়েছিস। টাকা আমার কাছেও নেই। বউ টাকা দেয় না। টাকা দিলেই খাওয়া-দাওয়া করব। এই জন্যে দেয় না। সে যেমন বুনো ওল আমিও তেমন বাঘা তেতুল। আমিও ব্যাঙচি —ঢাকা শহরে তিনটা জায়গায় ব্যবস্থা করা আছে। বাকিতে খাই, মাসকাবারি টাকা দেই। চল আমার সঙ্গে একটু হাঁটতে হবে। পারবি না?
পারব।
তোকে দেখে এমন ভাল লাগছে দোস্ত। আবার খারাপও লাগছে। খালি পায়ে হাঁটছিস দেখে মনে ব্যথা পেয়েছি। আই এ্যাম হার্ট। ভিক্ষা করে যে ফকির সেও স্পঞ্জের স্যান্ডেল পায়ে দেয়। আর তুই হাঁটছিস খালি পায়ে? তুই কোন চিন্তা করিস না—তোকে আমি ভাল এক জোড়া স্যান্ডেল কিনে দেব। প্ৰমিস। টাকা থাকলে আজই কিনে দিতাম। জুতার দোকানে বাকি দেয় না।
ব্যাঙচি আমাকে নিয়ে মালীবাগের এক কাবাব হাউসে ঢুকল। পিয়া কাবাব এণ্ড বিরানী হাউস। সাইনবোর্ডে রোগা পটকা এক খাসির ছবি। খাসির মুখটা হাসি হাসি। হাস্যমুখী ছাগল যে পেইন্টার একেছে। তাকে ধন্যবাদ দিতে হয়। মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণী হাসতে পারে না বলে যে ধারণা প্রচলিত তা যে সম্পূর্ণ ভুল হাস্যমুখী ছাগল দেখে তা বোবা যায়।
দোস্ত কি খাবি? যা খেতে ইচ্ছে করে খা। এটা বলতে গেলে আমার নিজেরই দোকান। মালিক আমার ভাগ্নে। আপন না, পাতানো। আপন ভাগ্নের চেয়ে পাতানে ভাগ্রের জোর বেশি তাতো জনিসই। জানিস না? বিরানী খাবি?
বিকাল বেলা বিরানী খাব?
বাসি বিরানী। এর টেস্ট আলাদা। গরম করে দিবে, নাশতার মত খা। বিরানী যত। বাসি হয় তত স্বাদ হয়।— ঘি ভেতরে ঢুকে। মাংস নরম হয়। মাংসের প্রত্যেকটা আঁশ আলাদা আলাদা হয়ে যায়। আমার কথা শুনে আজ খেয়ে দেখা। একবার খেলে আর টাটকা পোলাও খেতে পারবি না। শুধু বাসি পোলাও খাবি।