হিমু সাহেব?
জ্বি।
ভাগ্যটা কেমন জিনিস দেখলেন? আমি সারাদিন চুপচাপ বসে থাকি, চা খাই আর মনে মনে ভাগ্য কি সেটা ভাবি। কেন আমার দোকানে লোক আসবে না? আমি জিনিসের দাম বেশি রাখি না, কাষ্টমারের সঙ্গে তাল ব্যবহার করি। তারপরেও এই অবস্থা কেন? বড় ধরনের পীর-ফকির পেলে ডেকে জিজ্ঞেস করতাম। আপনার সন্ধানে কোন পীরফকির থাকলে নিয়ে আসবেন। উনাদের দোয়াতে যদি কিছু হয়। খরচপাতি যা লাগে আমি দিব। কথাটা মনে রাখবেন হিমু সাহেব।
জ্বি মনে রাখব।
চা কি আরেক কাপ খাবেন?
জ্বি না। আজ উঠি, কাজ আছে।
বসেন গল্প করি। চুপচাপ বসে থাকি –কথা বলার মানুষ নাই।
আরেক দিন এসে গল্প করব। আমার প্রচুর কাজ–একটা লোকের সন্ধান করছি। নাম ইয়াকুব।
শুধু নাম দিয়ে লোক খুঁজে বের করে ফেলবেন? এক কোটি লোক থাকে ঢাকা শহরে।
আমি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম, চেষ্টা করে দেখি।
দুপুরে চলে আসুন। আজ খিচুড়ি রাঁধতে বলেছি। আমার কাজের ছেলেটা ভাতমাছ রাঁধতে পারে না, খিচুড়ি পোলাও এইসব ভাল। রাঁধে।
দেখি সময় পেলে চলে আসব।
আমি আবারো পথে নামলাম। পায়ের ভাঙ্গা নখ কষ্ট দিচ্ছে। মানুষের দুটা অংশ শরীর এবং মন। মন অনেক কষ্ট সহ্য করতে পারে। শরীর কেন পারে না? শরীরের বয়স বাড়ে। মনের বাড়ে না। জড়া শরীরকে গ্ৰাস করতে পারে। মনকে পারে না। শরীরের মৃত্যু আছে মনের কি অবস্থা যে মন জড়াকে জয় করতে পারে সে নিশ্চয়ই মৃত্যুকেও জয় করতে পারে। এই জাতীয় দার্শনিক চিন্তা করতে করতে এগুচ্ছি।
রাস্তায় প্রচুর মানুষ। তাদের ব্যস্ততাও দেখার মত। রাস্তার পাশে চায়ের দোকানে বসে যে চা খাচ্ছে সেও ব্যস্ত। স্থির হয়ে চা খাচ্ছে না, সারাক্ষণ এদিকওদিক তাকাচ্ছে। এদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে রহস্যময় ইয়াকুব।
ঢাকা শহরের মানুষদের ঠিকঠাক পরিসংখ্যান থাকলে দেখা যেত এই শহরে মোট কতজন ইয়াকুব আছে। তিন থেকে পাঁচ হাজার থাকার কথা। এদের মধ্যে কেউ কেউ নিশ্চয়ই অসম্ভব বিত্তবান। কেউ হতদরিদ্র। দুএকজন পাওয়া যাবে সাধু সন্ত-মহাপুরুষ পর্যায়ের, কয়েকজন নিশ্চয়ই ভয়ংকর অপরাধী— খুনটুন করে ফেলেছে। কিছু থাকবে। রেপিষ্ট। নািদশ বছরের বালিকা রেপ করে লুকিয়ে আছে।
ঢাকা শহরের সব কটা ইয়াকুবকে একত্র করে একটা গ্রুপ ছবি তুলতে পারলে ভাল হত। এদের নিয়ে গবেষণাধর্ম একটা বইও লেখা যেত। —
A comprehensive study in the lives of
Yakubs of
Dhaka city.
বাংলায়—ঢাকা শহরের ইয়াকুবদের জীবন চর্চা। না বাংলা নামটা ভাল লাগছে। না। গবেষণাধর্মী বইয়ের নাম ইংরেজীতেই ভাল খুলে।
গরম লাগছে। শীতকালের রোদ খুব কড়া হয়। রোদটা জামা-কাপড় ভেদ করে চামড়ার ভেতর ঢুকে পড়ে। রোদ থেকে ছায়াতে গেলেই লাগে ঠাণ্ডা শীতকাল হল এমন
এক কাল যে কালে রোদেও থাকা যায় না, ছায়াতেও থাকা যায়না।
আমি ভিক্ষুক মেছকান্দর মিয়ার সন্ধানে বের হলাম। আজ সতেরো তারিখ এই খবরটা তাকে জানানো দরকার। বেচারা তারিখ জানতে চাচ্ছিল। যে পাথর আমাকে ব্যথা দিয়েছে তাকেও দেখে আসতে ইচ্ছা করছে। জগৎ অতি রহস্যময়। কে জানে একদিন হয়ত বৈজ্ঞানিকরা বের করে ফেলবেন জড় পদার্থেরও মন আছে। তাদের জীবনেও আছে আনন্দবেদনার কথা। আমার বাবা তার জবেদা খাতায় লিখে গেছেন।
মহাপ্ৰাণ নানান ভঙ্গিতে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। তিনি মানুষ হিসেবে নিজেকে প্ৰকাশ করেছেন, পশু কীটপতঙ্গ হিসেবেও নিজেকে প্ৰকাশ করেছেন। গাছপালাও মহাপ্ৰাণেরই অংশ। নদী, সাগর, বলি ধূলিকণাতেও তিনি নিজেকে প্রকাশিত করেছেন। বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের সকলই মহাপ্ৰাণের নানান রূপান্তর।
আমার পিতার কথা সত্যি হলে পাথরেরও প্ৰাণ থাকবে। যেহেতু সে পাথর তার প্রাণ হবে কোমল। সে মানুষকে ব্যথা দিচ্ছে ঠিকই কিন্তু নিজে সেই কারণে অনেক বেশি কষ্ট পাচ্ছে।
কে হিমু না
কে হিমু না?
আমি থমকে দাঁড়ালাম। পায়ের পাতা গরমে চিড়চিড় করছে। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা ভয়াবহ ব্যাপার। শীতকাল এখনো শেষ হয়নি। অথচ দিনের বেলায় চৈত্র মাসের গরম পড়ছে। আলনিনোর এফেক্ট হবে। রাস্তার পিচ এখনো গলা শুরু করেনি। তবে মনে হচ্ছে করবে। ভরদুপুর হলেও কথা ছিল। বেলা চারটার মত বাজে। বিকেল শুরু
হয়েছে। এখনো এত গরম।
কথা বলছিস না কেন? তুই হিমু না?
আমি বলতে যাচ্ছিলাম— জ্বি না। রং নাম্বার।
বলা হল না। এমন তো হতে পারে যে প্রশ্ন করছে—তাকেই আমি খুঁজছি। তার নামই ইয়াকুব। বাবার নাম সোলায়মান। আমার অনুসন্ধানের আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে গড় অলমাইটি তাকেই আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমি প্ৰশ্নকর্তার দিকে তাকলাম। প্ৰশ্নকর্তা মিডিয়াম সাইজ পর্বতের কাছাকাছি। টকটকে লাল শার্ট গায়ে দিয়ে আছেন। তাঁর বিশাল ভুরী শার্ট ছিঁড়ে যে কোন মুহূর্তে বের হয়ে আসবে বলে মনে হচ্ছে। মাথা পরিষ্কার করে কমানো। নেংটি পরিয়ে ছেড়ে দিলে জাপানী সুমে কুস্তিগীর হয়ে যাবে। জাপানীদের সঙ্গে চেহারার খানিকটা মিলও আছে। নাকি চ্যাপ্টা। চোখ ছোট ছোট। এর নাম ইয়াকুব হবার কোন কারণ নেই।
প্ৰশ্নকর্তা আহত গলায় বলল, মাই ডিয়ার ওল্ড ফ্রেণ্ড, তুই কি এখনো আমাকে চিনতে পারছিস না?
আমি বললাম, না এখনো চিনতে পারিনি। তাতে কোন অসুবিধা নেই। তুই আছিস কেমন দোস্ত? শরীরটা তো মাশাল্লাহ ভাল বানিয়েছিস।