ফাতেমা বালার সঙ্গে কথা বলা দরকার। তাঁকে জানানো দরকার যে প্রজেক্ট ইয়াকুবের কাজকর্ম পূর্ণ উদ্যাম চলছে। অনুসন্ধান সকল সম্প্রদায়ের মধ্যেই চলছে। ভিক্ষুক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি মেছকান্দর মিয়াকে দিয়ে অনুসন্ধানের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সাফল্য দ্বারপ্রান্তে। টেলিফোন কোথেকে করব বুঝতে পারছি না। সঙ্গে কার্ড নেই যে কার্ড ফোনে কথা বলব। টেলিফোনের দোকান খুলে যারা বসে আছে তাদের কাছে গেলে লাভ হবে না। তাদের হচ্ছে ফেল কড়ি মাখ তেল ব্যাপার। মালীবাগে আমার একটা টেলিফোনের বাকির দোকান আছে। সেখানে আমার নামে খাতা আছে। খাতায় নাম লিখে টেলিফোন করতে হয়। কল শেষ হবার পর দোকানের মালিক জগলু ভাই বিরস গলায় বলেন–টাকা তো অনেক জমে গেল হিমু সাহেব। কিছু অন্তত ক্লিয়ার করেন। আজ না পারলেও এই সপ্তাহের মধ্যে কিছু দিতে পারেন। কিনা দেখেন। চা খাবেন?
আমার টেলিফোনের এই বাকির দোকানের সবচে বড় সুবিধা হচ্ছে টেলিফোন শেষ হবার পর চা পাওয়া যায়। এক কাপ না, যত কাপ ইচ্ছা। দুপুরে গেলে জগলু ভাই জোর করে ভাত খাইয়ে দেন। রাতে বিপদে পড়লে ঘুমুবার ব্যবস্থাও আছে। জাগলু ভাই রাতে দোকানে থাকেন। শোরুমের পেছনে বড় ঘর আছে। সেই ঘরের সবটা জুড়ে খাট পাতা। রাতে উপস্থিত হলে তিনি মহা বিরক্ত হয়ে বলেন—কি ব্যাপার রাতে থাকবেন? বালিশ নেই, কোলবালিশ মাথার নিচে দিয়ে ঘুমুতে হবে। আর শুনুন, নাক ডাকাবেন। না। আমি সব সহ্য করতে পারি, নাক ডাকা সহ্য করতে পারি না।
জগলু ভাইয়ের দোকান থেকে ফাতেমা খালাকে টেলিফোন করলাম। ভারী গভীর পুরুষ কণ্ঠ শোনা গেল— কে কথা বলছেন? ফাতেমা খালার ম্যানেজার।
আমি বললাম, বুলবুল নাকি? ভাল?
কে, হিমু সাহেব?
জ্বি।
দয়া করে আমাকে কখনো বুলবুল ডাকবেন না। বুলবুল আমার ডাকনাম। আমার ভাল নাম রকিবুল। আমি ডাকনামে পরিচিত হতে চাই না। আমি পরিচিত হতে চাই ভাল নামে।
মহাকবি শেক্সপীয়ার নাম প্রসঙ্গে একটা কথা বলেছিলেন –গোলাপকে তুমি যে নামেই ডাক সে গন্ধ ছড়াবে।
দয়া করে আমার সঙ্গে শেক্সপীয়ার কপচাবেন না। এবং আমাকে কখনো বুলবুল ডাকবেন না।
আমার যদি কোনদিন খালার মত কোটি কোটি টাকা হয় তাহলে কি আপনাকে বুলবুল ডাকতে পারব?
আপনি কি ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলবেন?
জ্বি।
ধরুন দিচ্ছি। ম্যাডামের শরীরটা বেশি ভাল না। ডাক্তার তাকে মোটামুটি রেষ্টে থাকতে বলেছেন। কাজেই টেলিফোনে আপনি বেশিক্ষণ কথা বলবেন না।
জ্বি আচ্ছা। ব্রাদার শুনুন, আজ কত তারিখ বলতে পারবেন?
তারিখ দিয়ে অপনি কি করবেন? তারিখ তো অ্যাপনার কোন কাজে আসার কথা না।
আমার জন্য না। একজন ভিখিরী আমার কাছে তারিখ জানতে চাচ্ছিল। ভিখিরীর নাম মেছকান্দর মিয়া।
আজ ১৭ তারিখ। উনিশশো অষ্টআশি সাল। আপনি ধরে থাকুন। আমি ম্যাডামকে দিচ্ছি।
খালা এসে টেলিফোন ধরলেন। চিঁচিঁ গলায় বললেন, কে হিমু? আমি মারা যাচ্ছিরে।
কি হয়েছে?
ঘুম হচ্ছে না। সারারাত জেগে থাকি।
সে কি।
সূর্য উঠার পর ঘুম আসে। তখন দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘুমাই। তাও খুব অল্প ক্ষণ— ম্যাক্সিমাম দুই থেকে আড়াই ঘন্টা।
দুই আড়াই ঘন্টাই যথেষ্ট। নেপোলিয়ান তিন ঘন্টার বেশি ঘুমাতেন না।
গাধার মত কথা বলিস না, আমি কি নেপোলিয়ান?
অবশ্যই নেপোলিয়ান –মেয়ে মানুষ হয়ে এত বড় ব্যবসা দেখছি। তুমি কম কি? নেপোলিয়ানকে এই ব্যবসা দেখতে দেয়া হলে সে এক সপ্তাহের মধ্যে লাল বাতি জ্বলিয়ে সব ছেড়ে দূরে আসামের দিকে চলে যেত।
তোর কথাবার্তার ধরন আর পাল্টাল না। ইয়াকুবের খোঁজ বের করেছিস?
কাজ চলছে। শিগগিরই জানতে পারবে।
টাকাটা আলাদা করে রোখ। খালা –আমি দু একদিনের মধ্যে আসামী হাজির করছি।
আরে গাধা, তোকে কি বলেছি আসামী হাজির করতে হবে না। শুধু পেট থেকে কথা বের করবি।
নো প্রবলেম।
তাহলে টেলিফোন রেখে দেই। কথা বলতে পারছি না। মাথা ছিঁড়ে পড়ে যাচ্ছে। অসম্ভব যন্ত্রণা।
জামান কেমন আছে খালা।
জামান কেমন আছে মানে? জামানটা কে?
ঐ যে তামান্নার ছোট ভাই–রিকশা থেকে পড়ে পায়ে ব্যথা পেল। আমি ঠিক করে রেখেছি কুড়ি হাজার টাকা পেলে ছেলেটাকে একটা লেগো সেট উপহার দেব। জামানের বোন ভাল আছে তো?
তামান্নার কথা বলছিস?
হুঁ।
আশ্চৰ্য, এখনো তোর মাথায় তামান্না আছে? আমি তো ভেবেছি সব ভুলে বসে আছিস। তোর যা নেচার। তোকে তো আমি আজ থেকে চিনি না। যাই হোক, তুই তামান্নার ব্যাপারে ভাবিস না। আমি সব ব্যবস্থা করব। আমি তামান্নাকে কিছু হিন্টস দিয়েছি। সরাসরি তোর কথা বলিনি— ঘুরিয়ে বলেছি। ও দেখি খুবই লজ্জা পাচ্ছে।
অতিরিক্ত লজ্জার জন্যে আবার পিছিয়ে পড়বে না তো?
পিছিয়ে যাবে কোথায় –আমি এমন চাল চলিব।
খালা থ্যাংকস।
তোর পরিবর্তন দেখে আমি খুবই অবাক হচ্ছি। শোন হিমু, তোর জীবনটা আমি বদলে দেব। আমার ফার্মে তোকে চাকরি দেব।
স্যুট-টাই পরতে হবে?
পরতে হলে পরবি। স্যুট-টাই কি খারাপ? তোর হলুদ পাঞ্জাবীর চেয়ে ভাল।
তোমার মাথার যন্ত্রণা এখন একটু কম না?
হ্যাঁ কম। সকালে তো মাথা তুলতে পারছিলাম না। এমন অবস্থা। তুই ইয়াকুবের খোঁজ পেলেই আমাকে জানাবি। আমি ঘুমিয়ে থাকলে ঘুম থেকে ডেকে তুলবি।
আচ্ছা, খালা একটা কথা। —ইয়াকুব লোকটা দেখতে কেমন তা কি জান? মোটা না রোগা, লম্বা না বেঁটে?