আমার নাম মেছকান্দর মিয়া। বাড়ি বরিশাল নবীনগর।
ভিক্ষা শেষ করে যখন বাড়িতে ফিরে যাও তখন পাথরটা কি কর, সঙ্গে করে নিয়ে যাও?
আমি পাথর নিমু ক্যান? পাথর কি আমার?
এক জাগাত ভিক্ষা করি বইলা রোজগার কম। হাঁটাহাঁটিতে রোজগার বেশি।
হাঁটাহাঁটি কর না কেন?
ইচ্ছা করে না। সামান্য দুইটা পয়সার জন্যে অত খাটনী ভাল লাগে না। কারোর ইচ্ছা হইলে দিব। ইচ্ছা না হইলে নাই। আমি কি আফনের কাছে ভিক্ষা চাইছি?
না।
আফনের কাছে যেমন ভিক্ষা চাই না, অন্যের কাছেও চাই না।
শুধু তারিখ জানতে চাও?
হুঁ।
মেছকান্দর মিয়া তার ঝুলির ভেতর কি যেন খোঁজাখুজি করছে। এর বুলিও অন্যদের ঝুলির মত। শান্তিনিকেতনী কাপড়ের ব্যাগ। মেছকান্দর মিয়া বিড়ি বের করল। মুখে দিতে দিতে বলল, ফকির দুই কিসিমের আছে –ভিক্ষা চাওইন্যা ফকির। ভিক্ষা না চাওইন্যা ফকির। আমি হইলাম না চাওইন্যা।
ভাল কোনটা, চাওইন্যােটা, না না চাওইন্যাটা?
ভাল-মন্দ দুই দিকই আছে।
নখ থেকে রক্তপাত বন্ধ হচ্ছে না। আমি উঠে দাঁড়ালাম। রক্ত পড়ছে পড়ুক।
আমি বললাম, জানি না। মনে করার চেষ্টা করছি। যদি মনে পড়ে তোমাকে জানিয়ে যাব। আর শোন, পাথরটাকে যত্নে রেখো, এটা সাধারণ পাথর না। এই পাথর রহস্যময়।
মেছকান্দর আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আর আমি ভাবছি আজকের তারিখটা যেন কত? ফাতেমা খালার সঙ্গে দেখা হবার পর সাতদিন কি কেটে গেছে? আজকে কি ষষ্ঠ দিবস, না। সপ্তম দিবস?
ঘরে তারিখ ভুলে গেলে দেয়ালে ক্যালেন্ডার দেখা যায় –পথে ক্যালেণ্ডার ঝুলে না। নগরকর্তারা ধরে নেন যারা পথে নামে তারা তারিখ জেনেই নামে। এ জন্যেই শহরের মোড়ে মোড়ে ক্যালেন্ডার ঝুলে না।
ইদানীং ঢাকা শহর অনেক উন্নত হয়েছে –একটু পরপর দোকান সাজিয়ে চেংড়া ছেলেপুলে বসে আছে —আইএসডি টেলিফোন, দেশ-বিদেশে ফোন, ফ্যাক্স। এদের ব্যবসাও রমরমা। বাংলাদেশের মানুষ বিদেশে টেলিফোন করতে ভালবাসে।
ধাই ধাই করে যে দেশ এগুচ্ছে সে দেশের পথে পথে ক্যালেন্ডার থাকা দরকার। কাউকে কি জিজ্ঞেস করব। আজ তারিখ কত? কটা বাজে। জিজ্ঞেস করা সহজ। আজ কত তারিখ—জিজ্ঞেস করা খুব সহজ না। পরিচিত প্রশ্নের জবাব আমরা আগ্রহ করে। দেই। অপরিচিত প্রশ্নের জবাব দিতে থমকে যাই। ভুরু কুঁচকে ভাবি লোকটা এই প্রশ্ন করল কেন? সে তারিখ জানতে চায় কেন? রহস্যটা কি?
রাস্তার পাশে চিন্তিত মুখে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর বোধহয় অফিসে যাবার তাড়া। বেবীটেক্সি দেখা মাত্ৰ হাত উঁচু করছেন এবং এই বেবী এই বেবী করে। চেঁচাচ্ছেন। আমি তার পাশে দাঁড়ালাম এবং অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বললাম, স্যার আজ কত তারিখ?
যা ভেবেছিলাম। তাই, ভদ্রলোক জবাব দিলেন না। এমনভাবে তাকালেন যেন আমি ভয়ংকর কোন মতলব নিয়ে তার কাছে এসেছি। শুরুতে ভাল মানুষের মত তারিখ জানতে চাচ্ছি, তারপরই নিচু গলায় ফিসফিস করে বলব, মানিব্যাগ বের করুন। আপসে মানিব্যাগ আমার হাতে দিয়ে চলে যান। নো সাউন্ড প্লীজ। আমি ভদ্রলোককে আরো ভড়কে দিলাম। মহা বিনীত ভঙ্গিতে বললাম, এক্সকিউজ মি স্যার। আপনার নাম কি ইয়াকুব?
ভদ্রলোক কোন কিছু না বলে দ্রুত হাঁটতে শুরু করলেন। আজ মনে হয় তিনি বেবীটেক্সি নেবেন না। হেঁটেই অফিসে যাবেন। ভদ্রলোক হাঁটতে হাঁটতে একবার পেছনে ফিরলেন। ওমি আমি হাসলাম। হেসে তাঁর পেছনে পেছনে হাঁটা শুরু করলাম। ভদ্রলোক তাঁর হাটার গতি বাড়িয়ে দিলেন। আমিও বাড়িয়ে দিলাম। তিনি এখন প্ৰায় দৌড়াচ্ছেন। ভদ্রলোককে তাড়াতাড়ি অফিসে পৌছে দেবার ব্যাপারে সামান্য সাহায্য করছি। পরোপকার বলা যেতে পারে।
আচ্ছা নগরীর মানুষ কি বদলে যাচ্ছে? তারা এত সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠছে কেন? সবাই সবাইকে সন্দেহ করছে। আপনার নাম কি ইয়াকুব? এই নির্দোষ আতংকে অস্থির হওয়ার মানে কি? আপনার নাম কি গোলাম আযম? এই প্রশ্নে শঙ্কিত হওয়া যায়। এমন প্রশ্ন তো করছি না।
সামনের ভদ্রলোকের ভাগ্য ভাল। তিনি খালি বেবীট্যাক্সি পেয়ে প্রায় লাফিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে গেছেন। বেবীটেক্সির পেছনের জানোলা দিয়ে কৌতূহলী হয়ে আমাকে দেখছেন। তার চোখ থেকে ভয় এখনো কাটেনি। আমি টা-টা, বাইবাই ভঙ্গিতে হাত নড়লাম। তিনি চট করে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। অফিসে ফিরে এই ভদ্রলোক আজ রোমহর্ষক সব গল্প শুরু করবেন। তার সহকমীরা চোখ বড় র গল্প শুনবে —
ভয়ংকর এক বদমাশের পাল্লায় পড়েছিলাম। অল্পের জন্যে জীবনটা রক্ষা পেয়েছে। বেবীটেক্সির জন্যে অপেক্ষা করছি— হঠাৎ দেখি হলুদ পাঞ্জাবী পরা এক লোক এগিয়ে আসছে। তার একটা হাত পাঞ্জাবীর পকেটে। সে যখন আমার পাশে এসে দাঁড়াল, তখন বুঝলাম তার হাতে পিস্তল। মদ খেয়ে এসেছে। মুখ দিয়ে ভক ভক করে মদের গন্ধ আসছে। আমাকে বলল, তুমি ইয়াকুব?
আমি বললাম, জ্বি না।
সে বলল, মিথ্যা কথা বলছিস কেন? তোর নাম ইয়াকুব। আমি হতভম্ব। কি বলব। বা কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না।
সে বলল, কোন কথা না, আমার সঙ্গে গাড়িতে ওঠ। কুইক। নো সাউন্ড।
আমি তাকিয়ে দেখি রাস্তার পাশে একটা মাইক্রোবাস দাঁড়িয়ে আছে। মাইক্রোবাসে ছয় জন বসে আছে। তাদের গায়েও হলুদ পাঞ্জাবী। সবাই তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমার হাত-পা জমে গেল। আমি কোনমতে বললাম, আপনি ভুল করছেন …।
শ্রোতারা হতভম্ব হয়ে গল্প শুনবে। তারা যতই হতভম্ব হবে, গল্পের ডালপালা ততই ছড়াবে এবং একটা সময় আসবে যখন এই ভদ্রলোক নিজেই নিজের গল্প বিশ্বাস করতে শুরু করবেন। তিনি যদি লেখক হন তাহলে তাঁর আত্মজীবনীতে এই গল্প স্থান পাবে।