হুঁ।
ইচ্ছা করলে এখনই ঝাঁপ দিতে পারি, অপেক্ষায় আছি।
কিসের অপেক্ষা?
কানের ভেতরে দেয়াশলাইয়ের মাথা ফাটুক মজা দেখি। কানের ভেতরে ফায়ারিং হলে ওসি সাহেব নিজেই পানিতে বাপ দিবে। আমাকে ধাক্কা দিতে হবে না।
ওসি সাহেব বললেন, অনেক কথা হয়েছে, আর না। বিদায়। বিদায়। ওসি সাহেবের গলায় আগের জোর নাই। তিনি খানিকটা পুতিয়ে গেছেন।
ডিরেক্টর শাকুর এবং তার বন্ধু
এই দুজন মূল রঙ্গমঞ্চে অনুপস্থিত। তাদের এক কোনায় বিছানা পেতে আধশোয়া হয়ে থাকতে দেখা গেল। ডিরেক্টর সাহেবের হাতে মোবাইল ফোন। দুই বন্ধু গভীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে সুলতানার কর্মকাণ্ড দেখছে। মিডলক্লাস মানসিকতার নমুনা। ঝামেলা থেকে দূরে সরে ব্যক্তিগত আনন্দে সময় কাটানো।
আমি চলে গেলাম। একতলার নিচের মালঘরে। দুনিয়ার ড্রাম জড়ো করা। শত শত বস্তা। বস্তায় পানি পড়ছে, ভিজছে। কী আছে বস্তায় কে জানে। লাইফ বেল্ট পাওয়া গেল না।
হিমু ভাই, কিছু খুঁজেন?
আমি চমকে তাকলাম। টিনের ড্রামের উপর যে বসে আছে তাকে চিনলাম না। মুখভর্তি দাড়িগোঁফের জঙ্গল। গায়ে নীল গেঞ্জিতে লেখা—
Life starts at forty.
লেখার নিচে নগ্নবক্ষা এক থাই তরুণী। তরুণী চোখ টিপ দিয়ে তাকিয়ে আছে।
ভাইজান আমাকে চিনেছেন?
আমি আতর। এখন চিনেছেন? আতর মিয়া।
চিনলাম। গেঞ্জি তো পরেছ জবরদস্তি। আতর মিয়া মুখ বিকৃত করে বলল, এই জিনিস মানুষ পরে! বাধ্য হয়ে পরেছি। লোকজন আমার দিকে তাকায় না গেঞ্জির মেয়েটার দিকে তাকায়ে থাকে। আমারে কেউ চিনে না।
তুমি পলাতক?
জে। র্যাবের হাত থেকে বাঁচার জন্য সুন্দরবন চলে যাচ্ছি। মাসখানিক থাকব। র্যাব ঠান্ডা হলে ফিরব। আমাদের কাছে খবর আছে মাসখানিকের মধ্যে র্যাব ঠান্ডা হবে।
সুন্দরবনে যে যােচ্ছ তোমাকে তো বাঘে খেয়ে ফেলবে।
ক্রসফায়ারের চেয়ে বাঘ ভালো। হিমু ভাই! সুন্দরবন যাবেন? সপ্তাহখানিক থাকলেন। ফরেস্টের বাংলোয় থাকার ভালো ব্যবস্থা আছে। ফরেস্টের লোকজন দেখভাল করে। তাদের আদর যত্নও ভালো। ফ্রেশ হরিণের মাংস সাপ্লাই করে। ব্ল্যাব বাঁ পুলিশ যখন আসে তখন বনবিভাগ এডভান্স খবর দেয়। আমরা ডিপ ফরেস্টে চলে যাই।
তুমি কি আগেও ছিলে সুন্দরবনে?
কয়েকবার ছিলাম। র্যাবের যন্ত্রণায় মাঝে মধ্যে যেতে হয়। হিমু ভাই! আপনাকে পেয়েছি। এখন আর ছাড়ব না। সেবা করব। আপনাকে সেবা করা বিরাট ভাগ্যের ব্যাপার।
আমি বললাম, হরিণের মাংস ছাড়া সুন্দরবনে আর কী পাওয়া যায়?
ফ্রেন্স চিংড়ি খাবেন। চাষের চিংড়ি না। ভাঙ্গন মাছ আস্ত ভেজে দিবে। মাখনের মতো মোলায়েম। সামুদ্রিক রিটা কখনো খেয়েছেন? সামুদ্রিক রিটা খাবেন, সারা জীবন মনে থাকবে। হিন্দু এক বাবুর্চি আছে। নাম হরি ভট্টাচার্য। তার হাতে হরিণের মাংস অপূর্ব। মাংসটা মধু দিয়ে মাখায়ে দুদিন বাসি করে তারপর রান্না। আহা কী জিনিস! হিমু ভাই। এখন বলেন, লঞ্চে আপনার কোনো সেবা লাগবে? সিদ্ধান্ত নিয়েছি কিছুক্ষণের মধ্যে লঞ্চের দখল নিব।
একা?
আমারে চিনেন না হিমু ভাই? আমার কি দোকা লাগে? টাকা নিয়ে তিন আনসার পালায়েছিল। এদের ধরে টাকা উদ্ধার করেছি। তিনটাকে বাথরুমে তালাবন্ধ করে রেখে দিয়েছি। ওসি সাহেবকে পঞ্চাশ হাজার দিয়েছি। উনি আর শব্দ করবেন না। ঝিম ধরে থাকবেন। রুস্তম নামে একটা ফালাফালি করতেছে, তাকে একটা থাবড়া দিয়ে কনট্রোল নিজের হাতে নিব। তার আগে বলেন, আপনার কোনো সার্ভিস লাগবে?
না।
আমাকে শুধু একটা খবর দেন, লঞ্চটা কি ড়ুববে? লঞ্চ ড়ুবে যাবে, আপনে এডভান্স খবর পাবেন না-এটা কখনো হবে না।
লঞ্চ ড়ুববে।
আতর ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সামান্য সমস্যা হয়ে গেল। যাই হোক অসুবিধা নাই। আপনি আছেন কোথায়?
কেবিনে। কেবিন নাম্বার চার।
পাঁচ নাম্বার কেবিনে ফুর্তি করার জন্য এক হারামজাদা মেয়ে নিয়ে আছে। খবর পেয়েছেন?
হুঁ।
জাতি কোনদিকে যাচ্ছে খেয়াল করেছেন?
হুঁ।
লঞ্চ ড়ুবে গেলে সেটা সম্ভব হবে না।
আমি বললাম, এরা দুজন দরজা বন্ধ করে বসে আছে। আপাতত এদের বের করার ব্যবস্থা করো।
আতর বলল, চলেন যাই। বের করি। হালকা পাতলা দরজা। এক লাখি দিলেই ভেঙে হবে চাইর টুকরা।
আতর আমার সঙ্গে কেবিনের দিকে রওনা হলো। এখন আতর প্রসঙ্গে বলি। বায়তুল মোকাররমের সামনে আতর মিয়ার একটা আতর এবং তসবির দোকান আছে। দোকানোর নাম–
দি নিউ মদিনা আতার হাউস
দি নিউ মদিনা অতির হাউসে কাটনে করে ছোটখাটো অন্ত্রের লেনদেন হয়। আতর মিয়ার সব অ্যাসিসটেন্টের নাম পুলিশের সন্ত্রাসী তালিকায় আছে। আতরের নাম নেই। আতর মিয়ার কথা হচ্ছে-কোনো ইনসান আমার হাতে খুন হয় নাই। মানুষ হলেই ইনসান হয় না। মানুষের মতো দেখতে অনেক হায়ওয়ান ঘুরে বেড়ায়। এরা অফ হয়ে গেলে জগতের উপকার হয়।
আতর মিয়ার সঙ্গে আমার পরিচয়ের কাহিনীতে কোনো নাটকীয়তা নাই। সময় পেলে সেই গল্প করব। আজ সময় নেই। ঝড় শুরু হয়ে গেছে।
আচ্ছ, ঠিক আছে। ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেই গল্পটা করি। সেদিনও এরকম ঝড়বৃষ্টি। মানুষের যেমন ডিপ্রেশন হয় সাগর-মহাসাগরেরও ডিপ্রেশন হয়। বঙ্গোপসাগরে ডিপ্রেশন। সাত নম্বর বিপদ সংকেত। ঢাকায় বৃষ্টি, দমকা বাতাস। কিছুক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজালাম। বৃষ্টির পানি বরফের চেয়েও ঠান্ডা। শরীর হিম হয়ে গেছে। এক কাঁপা গরম চা খেতে পারলে ভালো হতো। চায়ের দোকানের সন্ধানে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি—দি নিউ মদিনা আতর হাউস থেকে একজন হাতের ইশারায় আমাকে ডাকল। কাছে গেলাম। সেই লোক সন্দিগ্ধ চোখে আমাকে দেখতে লাগল। একসময় বলল, আপনার পাঞ্জাবি হলুদ?