এই মেয়ে নদের চাঁদের মহুয়ার চেয়েও সুন্দর। মহুয়ার চেহারায় নিশ্চয়ই গ্রাম্য ভাব ছিল। এই মেয়ে টাকশালের নতুন রুপার টাকার মতো ঝকঝাক করছে।
অতি রূপবতীদের চেহারায় কোথাও-না-কোথাও কিছু ত্রুটি থাকে। আমি ক্ৰটি খুঁজে বেড়াচ্ছি। এমন কি হতে পারে মেয়েটার একটা দাঁত গেজা? কান ছোট বড়? নাকের ভেতর থেকে লোম উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে!
রূপবতী বলল, আপনি ট্যারা নাকি?
না। আমি একটা ভিডিও নাটকে সুযোগ পেয়েছি। নাটকের চরিত্র সুন্দর মেয়ে দেখলেই ট্যারা হয়ে যায়। প্রাকটিসের ওপর আছি। আপনাকে দেখে ট্যারা হওয়া প্ৰস্তুত করলাম। আপনার ভয় কি ক ক ক কমেছে?
তোতলাচ্ছেন্ন কেন?
আমি যে চরিত্রটা করছি সে যে শুধু ট্যারা, তা-না। তোতলাও।
ভালো কথা, আপনি করেন কী?
প্যাসেঞ্জারদের চা-পানি খাওয়াই। কেবিন ঝাঁট দেই। আপনি কি রাতে খাবার খাবেন? আগে অর্ডার দিয়ে রাখতে হবে।
আমি টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার নিয়ে এসেছি। বিশাল বড় টিফিন ক্যারিয়ারে করেক হাবার দিয়েছে, আমার মনে হয় লঞ্চের অর্ধেক মানুষ খেতে পারবে। আপনার নাম জানা হয় নি। আপনার নাম কী?
হিমু।
আমার নাম তৃষ্ণা। আমি বাংলাদেশে থাকি না! Ph.D করছি। Physics-এ, ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন।
থিসিসের বিষয় কী?
থিসিসের বিষয় বললে কি বুঝবেন?
বোঝার কথা না, তারপরেও বলুন।
হিগস কণা। কখনো নাম শুনেছেন?
হিগস হচ্ছে ঈশ্বরের কণা, এই কথা শুনেছি। তবে নামকরণ ভুল। সব কণাই ঈশ্বরের কণা। আপনার নাকে সামান্য সর্দির ইশারা দেখতে পাচ্ছি। সর্দি কণাও ঈশ্বরের কণা।
তৃষ্ণা নাক মুছতে মুছতে বলল, আপনি কি সত্যি লঞ্চের বয়?
তৃষ্ণার কথা শেষ হওয়ার আগেই লঞ্চ প্রবলভাবে দুলে উঠল। ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে গেল। মনে হয় বড় কোনো ঘূর্ণনে পড়েছে। তৃষ্ণা বলল, কী সর্বনাশ! হচ্ছেটা কি?
আমি বললাম, তেমন কিছু হচ্ছে না, লঞ্চ ঘুরছে। বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডে সব কিছুই ঘুরে। সূর্য ঘুরে, পৃথিবী ঘুরে, ইলেকট্রন ঘুরে, লঞ্চ কেন ঘুরবে না? তৃষ্ণা! শাড়িতে আপনাকে খুবই সুন্দর লাগছে, তবে আপনি শাড়ি পাল্টে শার্ট-প্যান্ট পরে নিন।
কেন?
লঞ্চ ভুবলে শাড়ি পরে সাঁতার কাটা মুশকিল।
এইসব আপনি কী বলছেন? সত্যি কি লঞ্চ ড়ুববে?
ড়ুববে। আমি একটা লাইফ বেল্ট জোগাড় করে নিয়ে আসি। লাইফ বেল্ট নিয়ে কেবিনে ঘাপটি মেরে বসে থাকবেন। লঞ্চ ড়ুবে যাওয়ার পর লাইফ বেল্ট নিয়ে বের হবেন। এর মধ্যে খাওয়াদাওয়া করে নিন।
Oh God! Oh God!
Oh God, Oh God করবেন না। বরং ও আলাহ ও আল্লাহ করুন। আল্লাহপাক নানান ধরনের ভাষা দিয়েছেন। তিনি বিভিন্ন ভাষায় তাঁকে ডাকা পছন্দ করেন।
আপনি অবশ্যই লঞ্চের বয় বেয়াক্কা কেউ না। প্লিজ। আপনার পরিচয় দিন।
কঠিন সমস্যায় ফেললেন।
কঠিন সমস্যা হবে কেন?
জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই মানুষ তার পরিচয় খুঁজে বেড়াচ্ছে, এখনো পরিচয় পায় নি। যেদিন সে তার পরিচয় পাবে সেদিনই সৰ্বজ্ঞানের সমাপ্তি।
আপনি চলে যাচ্ছেন নাকি?
হ্যাঁ।
প্লিজ আরেকটা সমস্যার সমাধান করে দিয়ে যান। আমার পাশের কেবিনে এক হাসবেন্ড-ওয়াইফ উঠেছেন। হাসবেন্ডের অনেক বয়স। স্ত্রী কমবয়েসী। ওয়া কেবিনে উঠেই দরজা বন্ধ করেছেন। আর দরজা খুলছেন না। মাঝে মাঝে ঐ কেবিনে একটা মুরগি ডেকে উঠে, তখন মহিলা ফুপিয়ে কাঁদতে থাকেন। আমি কয়েকবার ডাকাডাকি করেছি, কেউ সাড়া দিচ্ছে না।
মুরগি ডাকার ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না। রহস্যভেদের ব্যবস্থা করছি। আমি একটা চক্কর দিয়ে আসি তারপর দরজা ভেঙে এদের বের করার ব্যবস্থা করুব।
দরজা ভাঙতে হবে কেন?
দরজা না ভাঙলে এরা বের হবে না। এরা মোটেই স্বামী-স্ত্রী না। অসামাজিক কর্মকাণ্ডের জন্যে কেবিন ভাড়া করেছে। সারা রাত আমোদ-ফুর্তি করতে করতে যাবে। ভোরবেলা পৌঁছবে বরিশাল। এরা দুজন কেবিন থেকে নামবে না। সারা দিন কেবিনে থাকবে। খাওয়াদাওয়া করবে। রাতে ঢাকা ফিরবে। লঞ্চের সঙ্গে এই বন্দোবস্ত।
আপনি জেনে বলছেন, নাকি অনুমানে বলছেন?
জেনেই বলছি। সারেঙের অ্যাসিসটেন্ট হাবলু মিয়ার সঙ্গে আমার কিঞ্চিৎ ভাব হয়েছে। সে-ই বলেছে। তিন নম্বর কেবিনের এক প্রফেসর সাহেবও এই চুক্তিতে ভাড়া নিয়েছিলেন। তার ছাত্রী সঙ্গে যাবে। শেষ মুহুর্তে ছাত্রী আসে নি। প্রফেসর সাহেব মুখ ভোতা করে বসে আছেন। তার ভাড়ার টাকা পুরোটাই জলে গেছে। টাকা শুধু যে জলে গেছে তা না, তিনি নিজেও জলে যাবেন এই উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
কালের চিৎকার পত্রিকার চলমান লঞ্চ সাংবাদিক হিসেবে কোথায় কী ঘটছে দেখা দরকার। আমি ভ্রমণে বের হলাম। তৃষ্ণা মেয়েটি ভয় পেতে থাকুক। ভয় ভাঙানোর জন্য যথাসময়ে তার কাছে যাওয়া যাবে। তৃষ্ণা ছাড়া লঞ্চের আর কাউকে উীত দেখলাম না। সবাই স্বাভাবিক অৰ্দ্ধাচরণ করছে। লঞ্চ মোহনায় ঘুরপাক খাচ্ছে—এটা যেন কোনো ব্যাপার না।
এখন কালের চিৎকার প্রতিবেদকের প্রতিবেদন।
আনসার বাহিনী
আনসার বাহিনীর চার সদস্যের তিনজন টাকা নিয়ে পলাতক। একজন পাবলিকের কাছে ধরা খেয়েছে। তাকে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। শোনা যাচ্ছে তাকে পানিতে ফেলা দেওয়া হবে। যিনি তাকে পানিতে ফেলার ঘোষণা দিয়েছেন তার নাম রুস্তম। মধ্যমবয়সী গাটাগোট্টা মানুষ। কুৎকুতে চোখ। চিবুকে ছাগলা দাড়ি। রুস্তম বরিশাল ট্রাকচালক সমিতির কোষাধ্যক্ষ। বক্তৃতা দেওয়ার অভ্যাস আছে। কিছুক্ষণ তার জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনলাম।