আমি বললাম, মোবাইল ফোন আপনার কাছে থাকুক। অবসর সময়ে আপনার সঙ্গে আরাম করে দেখব। এইসব জিনিস একা দেখা যায় না।
সত্যি কথা বলেছেন। যান কোথায় যাচ্ছেন, ঘুরে আসেন। তারপর তিন ভাই মিলে আরাম করে দেখব। দেখার মতো অনেক জিনিস আছে।
আমি দােতলার ডেকে চলে গেলাম। বৃদ্ধ আগের জায়গাতেই বসা। আমাকে দেখে করুণ গলায় বলল, বাজােন। চাদরটা কি দিবেন? আমার শীত লাগতেছে।
আমি বললাম, লঞ্চ বন্ধ। বাতাস নাই। শীত লাগবে কেন?
বৃদ্ধ চিন্তিত গলায় বলল, লঞ্চ বন্ধ কী জন্যে?
জানি না। খোঁজ নিব?
বাজান! খোঁজ নেন। জানি না। কী জন্যে যেন ভয় লাগতেছে।
লঞ্চের খোঁজ নিয়ে জানলাম, অবস্থা ভয়াবহ। একই সঙ্গে লঞ্চের হাল ভেঙেছে, ইঞ্জিন নষ্ট হয়েছে। লঞ্চ আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে পানিতে ভাসছে। সারেঙের নাম খালেক। বাড়ি চট্টগ্রাম। তার জ্বর উঠেছে একশ পাঁচ। সে বিড়বিড় করে আপন মনে কথা বলে যাচ্ছে। সকিনার মা নামে একজনকে চোখ বড় বড় করে খুঁজছে। যে পানি ঢালছে, কিছুক্ষণ পর তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলছে, ও সকিনার মা, তুই কন্ডে? আঁর শরীর পুড়ি যার গৈ। তুই কডে?
লঞ্চ চাঁদপুরকে বাঁ-পাশে রেখে চলে যাচ্ছে। আব্দুল খালেক লাফ দিয়ে উঠে বিছানায় বসল। ঝলমলে চাঁদপুরের দিকে তাকিয়ে আনন্দিত গলায় বলল, যারগৈ! চানপুর যারগৈ। চাঁদপুর চলে যাওয়াতে তাকে খুবই আনন্দিত মনে হচ্ছে।
লঞ্চ মোহনায় দুলছে
এখন মধ্যরাত্রি। লঞ্চ মোহনায় দুলছে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। যে-কোনো মুহূর্তে ঝড় শুরু হবে। ঝড়ের সময় লঞ্চকে কে সামলাবে বোঝা যাচ্ছে না। সারেং খালেকের জ্বর আরও বেড়েছে। মাথায় পানি ঢেলে এই জ্বর কমানো যাবে না। দমকল ডাকতে হবে।
অল্প বাতাস ছেড়েছে, এতেই লঞ্চ এপাশি-ওপাশ করা শুরু করেছে।
ছোট জেনারেটর এতক্ষণ চলছিল। কিছুক্ষণ আগে জেনারেটর বন্ধ হয়েছে। পুরোপুরি বন্ধ হয় নি, মাঝে মাঝে চালু হচ্ছে। এখন ভরসা কয়েকটা হারিকেন। আজকালকার চায়নিজ মোবাইলে টর্চলাইটের মতো থাকে। মোবাইলধারীরা তাদের টর্চলাইট জ্বালিয়ে দিয়েছে। এতে অন্ধকার কমে নি, বরং বেড়েছে।
সারেঙের মাথায় যে পানি ঢালছে তার নাম হাবলু মিয়া। বয়স পনের-ষোল। হাস্যমুখী। সম্ভবত তার জীবনের মটো হলো, সৰ্ব্ব অবস্থায় আনন্দে থাকতে হবে।
আমি বললাম, লঞ্চের লোক বলতে কি তোমরা দুজন? আর কেউ নাই?
কী বলেন স্যার! দুইজনে কি এতবড় লঞ্চ চলে? ইঞ্জিন মাস্টার আছে। খালাসি আছে। লঞ্চমালিকের ছোটপুলা কাদের সাব আছেন।
কাদের সব কোথায়?
সারেঙের কেবিনে আছেন। উনার কাছে খবৰ্দার যাবেন না।
সমস্যা কী?
উনি অসামাজিক কাজে ব্যস্ত। তার উপর মাল খেয়েছেন। স্যারের কেবিনে মেয়েছেলে আছে।
বলো কী?
উনার সঙ্গে লাইসেন্স করা পিস্তল আছে। মিজাজও উগ্র। আমারে তাক কইরা একবার গুল্লি দিছিলেন। নিশা অবস্থায় ছিলেন বইল্যা গুল্লি লাগে নাই। নিশার মধ্যেও উবগার আছে।
নিশার উপকারের কথা ভেবেই হয়তো হাবলু মিয়া মনের আনন্দে হলুদ দাঁত বের করে হাসল। তার কাছ থেকে লঞ্চে অসামাজিক কাজের নানান গল্প শুনে ডেকে ফিরছি, হঠাৎ একটা কেবিনের জানালা খুলে গেল। আতঙ্কিত এক তরুণীর পল শোনা গেল!
এক্সকিউজ মি! আপনি কি এই লঞ্চের কেউ? আমি বললাম, হ্যাঁ। ম্যাডাম কী লাগবে বলুন? চা খাবেন? চা এনে দিব?
চা আমার সঙ্গে আছে। চা লাগবে না। আপনি এক মিনিটের জন্যে কেবিনে আসবেন? আমি প্ৰচণ্ড ভয় পাচ্ছি।
সাঁতার জানেন না?
সাঁতার কেন জানতে হবে? লঞ্চ কি ড়ুবে যাবে নাকি?
হ্যাঁ ড়ুববে। তবে সাঁতার জেনেও লাভ নেই। তারপরেও গাপপুর-গুপপর করে কিছুক্ষণ ভেসে থাকা।
প্লিজ আপনি কেবিনে এসে কিছুক্ষণ বসুন।
আপনি একা?
জি আমি একা। আমি আমার মামার বাড়ি বরগুনা যাচ্ছি। সবাই বলছিল বাই রোডে যেতে। আমি ইচ্ছা করে লিঞ্চে যাচ্ছি। অনেকেই আমার সঙ্গে আসতে চেয়েছিল। আমি কাউকে আনি নি। আমার আত্মীয়স্বজনরা সারাক্ষণ বকবক করে। ওদের বকবকানি শুনতে ভালো লাগে না।
ওদের না। এনে ভালো করেছেন। দলবল নিয়ে মারা যাওয়ার কোনো মানে হয় না। কবি রবীন্দ্ৰনাথ এইজন্যেই বলেছেন, একলা মরো, একলা মরোরে।
উনি এক মরতে বলেছেন?
উনি একলা চলতে বলেছেন। মৃত্যুও তো অনির্দিষ্টর দিকে চলা।
লঞ্চ কি সত্যি ড়ুববে?
ঝড় উঠলেই ড়ুববে। ঝড় এখনো ওঠে নি। ঝড় উঠলেই দেখবেন লঞ্চ ডানদিকে কান্ত হয়ে ভূস করে ড়ুবে যাবে। আপনার সঙ্গে ভিডিও ক্যামেরা আছে? ভিডিও ক্যামেরা থাকলে লঞ্চ ড়েবার প্রক্রিয়াটা ভিডিও করে রাখতে পারেন। ভিডিও করার সময় বঁটা দিকে থাকবেন। খেয়াল রাখবেন লঞ্চ ড়ুববে ডানদিকে।
ডানদিকে কত হবে কেন?
কারণ লিঞ্চের লোকজন ডানদিকে মালামাল বোঝাই করেছে।
প্লিজ ভেতরে এসে কিছুক্ষণ বসুন। প্লিজ। আমার কাছে চার্জ লাইট আছে। চার্জলাইট জ্বালাচ্ছি।
আমি কেবিনে ঢুকলাম। পাশাপাশি দুটা বিছানা। আমি মেয়েটির মুখোমুখি বসলাম। প্রথমবারের মতো তার দিকে ভালোমতো তাকলাম। কিছুক্ষণের জন্যে আমার বাকরুদ্ধ হলো।
নদের চাঁদের সঙ্গে এই মেয়ের দেখা হলে তিনি বলতেন,
বাড়ির কাছে শানে বাঁধা চারকোনা পুসকুনি
সেই ঘাটোতে তোমার সঙ্গে সাঁতার দিব আমি।।
অন্দরমহলে আমার ফুলের বাগান
দুইজনে তুলব ফুল সকাল বিহান।।
চন্দাহার পরাইয়া নাকে দিব নথ।
নূপুরে সোনার ঝুনঝুনি বাজবে শত শত।।