লাস্ট সাপারে তেরজনের মধ্যে একজন কোনো খাদ্য গ্ৰহণ করে নি। আমাদের মধ্যে সেই একজনও আছেন। তিনি হচ্ছেন পীর হাবীব কুতুবি। এখন আর পুলিশরা তার পেছনে নেই। সবাই নিজের জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত। ফাঁসির আসামি কোথায় তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই।
হাবিব কুতুবি খাদ্য গ্রহণ করছেন না। কারণ তিনি রোজা। আমি বললাম, রাতের বেলা কিসের রোজা? পীর সাহেব বললেন, সৌদি টাইমিংয়ে এখন দিন। আমি সেই টাইমে রোজা রেখেছি। আপনাদের কাছে বিষয়টা কি পরিষ্কার হয়েছে?
কেউ জবাব দিল না। পীর হাবিব বললেন, সময় হলো অন্তরের মধ্যে। অন্তরে আপনি যে সময় নির্ধারণ করবেন, আপনের সময় সেইটাই।
তৃষ্ণ বলল, আলোচনা ফিলসফির দিকে চলে যাচ্ছে। আপনি সাধারণ কথাবার্তা বলুন, যাতে আমরা সবাই বুঝতে পারি।
আতর মিয়া বিরক্ত গলায় বলল, আপনি থাকেন বাংলাদেশে, রোজা রাখেন। সৌদি টাইমিংয়ে—এটা কেমন কথা! কত বড় সৌদি পীর হয়েছেন আমাকে দেখান। গলার কাটা নামায়ে দেন।
পীর হাবিব বললেন, আপনার গলার কাঁটা আমি কেন জ্বিন কফিলও নামাতে পারবে না। কারণ আপনার গলায় কাঁটা বিধে নাই। কাঁটা বিধেছে আপনার অন্তরে। অন্তরের কাঁটা আপনাকেই সরাতে হবে। অন্য কেউ পারবে না। দুষ্ট লোকের অন্তরে কাঁটা থাকে।
আতর মিয়া বলল, আপনি তো খুন করেছেন তিনটা। আপনার অন্তরে কাঁটা নাই?
এইখানে ভুল করেছেন। খুন আমি করি নাই। খুন করেছে জ্বিন কাফিল।
তৃষ্ণা বলল, এইসব হাস্যকর কথাবার্তা এখন বলবেন না। আমরা গল্পগুজব করছি, আনন্দে থাকার চেষ্টা করছি। গল্প শুনুন, আনন্দে থাকার চেষ্টা করুন।
আমি আনন্দেই আছি। মনে মনে জিগির করতেছি, এতেই আমার আনন্দ। খাওয়া শেষ করেন তারপর আমার সঙ্গে জিগিয়ে সামিল হন।
লাঠি হাতে বুড়ো মিয়া বলল, আমি যে আপনাদের একটা মিমাংসা দিছিলাম তার সমাধান কি দিব?
আমি বললাম, মিমাংসাটা নিয়ে আমরা সবাই চিন্তা করছি। এখন না বললেই ভালো।
তৃষ্ণা বলল, একটা কাজ করলে কেমন হয়? আমরা সবাই এই পর্যন্ত জীবনে সবচেয়ে ভালো কাজ কী করেছি সেটা বলি। পীর কুতুবিকে দিয়ে শুরু করি। আপনি বলুন।
পীর কুতুবি বললেন, সত্যি কথা বলতে কী, আমি তেমন কোনো ভালো কাজ করি নাই। জ্বিন কফিল করেছে। সে আমার স্ত্রী এবং দুই শালিকাকে খুন করেছে। এই ভালো কাজের জন্য সে বেহেশতবাসী হবে।
আমি বললাম, মানুষের বেহেশত আর জিনের বেহেশত কি আলাদা? নাকি একই বেহেশতে আমরা থাকব?
পীর কুতুবি বললেন, তফসিরে বাইজাবিনে অর্থাৎ সূরায়ে জিনের তফসিরে আছে জিনদের দোজখ শীতল। সেখান থেকে মনে হয় আমাদের এবং জিনদের বেহেশত দোজখ আলাদা।
তৃষ্ণা বলল, আতর মিয়া আপনি বলুন। এক জীবনে ভালো কাজ কী করেছেন?
আতর বলল, প্রফেসর সাবরে কানে ধরে খাড়া করাইয়া থুইছি—এইটাই আমার ভালো কাজ। পাছায় লাথি দিয়া পানিতে ফেললে উন্নতমানের ভালো কাজ হইত। কী আর করা!
তৃষ্ণা বলল, আপনার কাঁটা কি এখনো আছে? আতর বলল, আগে ভাবছিলাম কাঁটা একটা ফুটছে। এখন মনে হইতেছে দুইটা।
সবাই হেসে উঠল। আমরা আনন্দ পেতে শুরু করেছি। লাস্ট সাপারের শুরুতে সবাই আনন্দেই ছিলেন।
আনন্দভঙ্গ হয় খাবার শুরুর কিছুক্ষণ পর। লাস্ট সাপারে রেডওয়াইন দেওয়া হয়েছিল। রেডওয়াইনের অভাব অনুভব করছি। আমি তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে বললাম, তোমার কাছে কি রেডওয়াইনের একটা বোতল আছে?
তৃষ্ণা বলল, আমার কাছে রে ওয়াইনের বোতল থাকবে কেন?
তুমি সারা জীবন বিদেশে থেকেছ, এইজন্যে বললাম। সেখানে তো খাবার হিসেবে রেডিওয়াইন খাওয়া হয়।
তুমি বিদেশে যাও নি তো এই জন্যেই বিদেশ সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নেই। বাঙালিরা সেখানে অত্যন্ত কনজারভেটিভ জীবনযাপন করে। পুরুষরা দাড়ি রাখে না, তবে মেয়েরা হিজাব পরে। হঠাৎ রেডওয়াইনের বিষয় এল কেন? তুমি কি ওয়াইন খাও?
না। তবে আজ খেতে ইচ্ছা করছে।
তৃষ্ণা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার কাছে খুব দামি এক বোতল রেডওয়াইন আছে। স্পেনের তৈরি। কেন কিনেছিলাম জানি না। মনে হয় তুমি খেতে চাইবে ভেবে কিনেছি।
আমি বললাম, হতে পারে। সবকিছু যদি প্রিডিটারমিনড হয় তাহলে আমি যে আজ রাতে ওয়াইন খেতে চাইব এটাও পূর্বনির্ধারিত।
বুড়ো মিয়া বিরক্ত গলায় বল, আম্মুজি, আপনার কথাবার্তা কিছু বুঝতেছি না! আমি যে মিমাংসা দিলাম। তার কী উত্তর? —
আমরা খাচ্ছি। লিঞ্চ ড়ুবিছে। কৃষ্ণা ওয়াইনের বোতলের মুখ খুলতে খুলতে বলল, হাউ এক্সাইটিং!
কী সুন্দর যে তাঁকে লাগছে। আমি মনে মনে বললাম, মুখের পানে চাহিনু অনিমেষ, বাজিল বুকে সুখের মতো ব্যথা।
তৃষ্ণা চমকে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাকে একটা কথা বলতে ভুলে গেছি! আমি মাঝে মাঝে মানুষের মনের কথা বুঝতে পারি।
নিচ থেকে বিকট হৈচৈ শোনা যাচ্ছে। মনে হয় লঞ্চ তলিয়ে যেতে শুরু করেছে।
===============
প্রকাশকের মন্তব্য
লেখক যে জায়গায় উপন্যাস শেষ করেছেন, সেখানে উপন্যাস শেষ হয় না। লঞ্চ কি আসলেই ড়ুবেছে? যদি ড়ুবে গিয়ে থাকে তাহলে হিমুর কী হয়েছে? তৃষ্ণার পরিণতি কী?
এই বিষয়গুলো নিয়ে আমরা লেখকের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি বলেছেন, হিমু এখন আমার গ্রিপে নেই। সে অনেকটাই পাঠকের সম্পত্তি। উপন্যাসের শেষটা আমি পাঠকদের হাতে ছেড়ে দিয়েছি। কোনো পাঠক ইচ্ছা করলে লঞ্চ ড়ুবিয়ে সবাইকে মেরে ফেলতে পারেন। আবার কেউ ইচ্ছা করলে উদ্ধারকারী জাহাজ আনতে পারেন।