তোমাকে কে বলেই?
বোমার হাত থেকে বেঁচে যাওয়া একজন জাপানির আত্মকাহিনী থেকে জেনেছি।
কাজেই আমরা ড়ুবছি?
হ্যাঁ। তবে আমাদের হাতে সময় আছে। আমরা ভালো মতো ডিনার শেষ করব। যা ঘটার তারপর ঘটবে।
হাবলু এসে ঢুকল। তার মুখভর্তি হাসি।
আমি বললাম, ঘটনা কিরে হাবলু?
হাবলু সব দাঁত বের করে বলল, লঞ্চ ড়ুবতাছে স্যার। একতলায় কোমর পানি। কান্নাকাটির ধুম পড়ছে।
আমি বললাম, খুব আনন্দ পাচ্ছ, তাই না হাবলু? হাবলু হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
তৃষ্ণা বলল, হাবলু সাঁতার জানো?
হাবলু বলল, জে-না। বলেই খিকখিক করে হাসি।
বাজিল বুকে সুখের মতো ব্যথা
আমরা খেতে বসেছি।
খাবার আয়োজন ফাষ্ট ক্লাস ডেকে। কেবিন থেকে হাবলু এবং তৃষ্ণ খাবার নিয়ে আসছে। সব মিলিয়ে তেরজন অভুক্ত মানুষ পাওয়া গেছে।
ঝড়ের প্রকোপ একটু কম। এত আশান্বিত হওয়ার কিছু নেই। খবর পাওয়া গেছে ড়ুবন্ত চরে ধাক্কা খেয়ে লঞ্চের তলা ফেটে গেছে। লঞ্চে পানি উঠছে। দুটা চাপকল ব্যবহার করে পানি সরানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। যে হাৱে পানি বের হচ্ছে তারচেয়ে বেশি পানি ঢুকছে। ছোটবেলার চৌবাচ্চার অংক। কেউ ঠিকমতো হিসাব করতে পারলে কতক্ষণে লঞ্চ ড়ুবে যাবে তা বের করে ফেলতে পারবে। অংক করার মুড়ে কেউ নেই, তবে ড. জিম্বুর রহমান ব্যাপারটা দেখছেন। কী হারে লঞ্চ ড়ুবছে সেটা মনে হয় তিনি জানেন। তাঁর ছাত্রী পাশেই আছে। ড. জিলুর মাঝে মধ্যেই হতাশ চোখে ছাত্রীর দিকে তাকাচ্ছেন। তাদের মধ্যে কিছু কথাবার্তাও হচ্ছে। আগের বৈরী ভাব এখন আর নেই।
রশীদ খান এবং রুস্তম। এই দুজনও চাপকলের তদারকিতে আছে। একটা চাপকল রুস্তম কিছুক্ষণ চাপছে, সে ক্লান্ত হয়ে পড়লে রশীদ খান চাপছেন। তবে দুজনেরই কল চাপার দিকেই আগ্রহ। আতর মিয়ার নির্দেশ, দুজনের একজন যখন কল চাপবে না। সে তখন কানো ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে।
আতর মিয়ার হাতে এখন পূর্ণ ক্ষমতা। ক্ষমতাধররা ক্ষমতার ব্যবহার করতে ভালোবাসেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার বাহিনীর হাতে রাশিয়ান আর্মির আর্টিলারির এক বিগ্রেডিয়ার ধরা পড়েছিলেন। তাকে বলা হলো কুকুরের মতো জিভ বের করে রাখতে। যেই মুহুর্তে জিভ মুখের ভেতর ঢুকবে সেই মুহূর্তেই তাকে গুলি করা হবে। ব্রিগেডিয়ার জিভ বের করে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাবার চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন।
ডিরেক্টর শাকুর এবং তার বন্ধু বড় একটা কাঠের তক্তা জোগাড় করেছে। দুজন সেটা আগলে রাখছে, কাউকে আশপাশে ঘিরতে দিচ্ছে না। কিছু মানুষ আছে মহা বিপদে আনন্দে থাকে। এরাও মনে হচ্ছে সেরকম।
আমাদের খেতে বসার সঙ্গে লাষ্ট সাপারের কিছু মিল খুঁজে পাচ্ছি। নিউ টেস্টামেন্টে বলা হচ্ছে যিশুখ্রিষ্ট শেষ খাবার খেতে বসেন উপরের তলায় (আমরা ডেকে খেতে বেসেছি!) নিচতলা থেকে খাবার নিয়ে আসছিল তাঁর দুজন অনুসারী (ডেক থেকে খাবার আনছে হাবলু এবং তৃষ্ণা)। যিশুখ্রিস্টের সদস্য সংখ্যা ছিল তের। আমরাও তেরজন। যিশুখ্রিস্টের সদস্যদের মধ্যে একজন ছিলেন মহিলা। আমাদের মধ্যে যেমন তৃষ্ণা। নিউ টেস্টামেন্ট খাবারের বর্ণনায় মাছের কথা উল্লেখ করেছে। আমাদের খাবারে মাছ আছে। তৃষ্ণা আস্ত একটা ইলিশ মাছ ভেজে এনেছে। লুকের বর্ণনায় (২২:৭-৩৮) তখন বাইরে আবহাওয়া ছিল খারাপ। খেতে বাসা তেরজনের মধ্যে একজনের হাতে ছিল বাঁকা লাঠি।
বুড়ো মিয়ার হাতে একটা বাঁকা লাঠি। বুড়ো মিয়া সবাইকে একটা ধাঁধা। দিয়েছেন। তাঁর ধাঁধাটি এরকম—এক বৃদ্ধা আজরাইলের হাত থেকে বাঁচতে চায়। সে একটা কৌশল বের করল যেন আজরাইল তাকে খুঁজে না পায়। কৌশল কাজ করল। আজরাইল তাকে খুঁজে পেল না। কৌশলটা কী?
তৃষ্ণা বলল, আমি এই গল্পটা জানি। কৌশলটা কী বলতে পারব। তাতে অন্যদের মজা নষ্ট হবে। দেখা যাক অন্যরা কেউ পারে কি না। আমি আপনাকে কানে কানে কৌশলটা বলি।
তৃষ্ণা বৃদ্ধের কানে কানে কিছু বলল। বৃদ্ধ আনন্দিত গলায় বলল, আম্মা, হইছে। আম্মার বেজায় বুদ্ধি। এই ধাঁধার উত্তর কেউ দিতে পারে না। আপনে পারছেন। আলহামদুলিল্লাহ।
সবাই কৌশল বের করার চিন্তায় অস্থির। সবচেয়ে অস্থির আতর মিয়া। সম্ভবত কৌশল জানার প্রয়োজন তারই সবচেয়ে বেশি।
আতর মিয়া বসেছে ঠিক আমার পাশে। সে ইলিশ মাছ খাচ্ছে না। মাছ খেলেই তার গলায় কাটা ফুটে। তা সে যে মাছই হোক। একবার নাকি পাবদা মাছ খেয়েও তার গলায় কাটা ফুটেছিল।
আমি বললাম, গলায় মাছের কাঁটা ফুটা নিয়ে একটি কথা ইন্দোনেশিয়ায় চালু আছে। কথাটা শুনতে চাও?
চাই।
দুষ্ট লোকদের গলাতেই সবসময় কাটা ফুটে। এটা নাকি প্রকৃতির নিয়ম। গলায় কঁটা বিধিয়ে সারাক্ষণ মনে করিয়ে দেওয়া তুমি দুষ্ট।
আতর বলল, এটা একটা ভুল কথা।
হতে পারে ভুল কথা।
আমি সবার সামনে ইলিশ মাছ খাব। দেখবেন কাটা ফুটবে না। পরীক্ষা হয়ে যাবে।
সবাই তাকাচ্ছে আতর মিয়ার দিকে। আতর অনেকখানি মাছ খেয়ে হাসিমুখে বলল, কাঁটা লাগে নাই।
তৃষ্ণা বলল, এই মাছটি এমনভাবে রান্না হয়েছে যেন কোনো কাটা না থাকে। তারপরেও আপনার গলায় কাটা ফুটেছে। আপনি ভাব করছেন কাটা ফুটে নি। হুদা-ভাত খান, কাঁটা চলে যাবে। আমরা মহা বিপদে আছি, লঞ্চ ড়ুবে যাচ্ছে— এইসময় আমরা কেন ভান করব? সবাই সত্যি কথা বলার চেষ্টা করব।
আতর মিয়া শুধু ভাত মাখিয়ে গেলার চেষ্টা করছে। শুধু ভাত গেলা কঠিন কর্ম। তাকে লজ্জিত এবং বিব্রত মনে হচ্ছে। সবার দৃষ্টি এখন তার দিকে। গলার কাটা নামানোটাই এখন প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রাত্যহিক জীবনে মাঝে মাঝে অতি তুচ্ছ বিষয় প্রধান হয়ে দাঁড়ায়।