এই ঘটনার ফলাফল কী বুঝতেই পারছেন। আমার স্ত্রী বঁটি নিয়ে গেছে রেশমাকে মারতে। এতবড় পদক পেয়েছি কোথায় আমোদ-ফুর্তি হবে তা না বঁটি নিয়ে দৌড়াদৌড়ি।
পদক এখন কার দখলে?
রেশমার দখলে। তার এক কথা—দুলাভাই আমাকে আদর করে দিয়েছেন, এটা আমি মরে গেলেও দিব না। প্রয়োজনে হাতের কব্জি কেটে দিব। তার কথায় যুক্তি আছে। আপনি কী বলেন?
যুক্তি আছে। পদকটা তো আপনার। আপনি যাকে ইচ্ছা দিবেন। আমার ভোট আমি দিব যাকে ইচ্ছা তাকে দিব। অনেকটা এইরকম।
এই তো আপনি বুঝেছেন।
রেশমার সঙ্গে মোবাইলে কথা হয়েছে?
না। আমি বিপদে আছি শুনলেই কেঁদে বুক ভাসাবে। তাকে কষ্ট দিয়ে লাভ কী?
ভাবিকে জানিয়েছেন?
মুটকিকে কিছু বলা না-বলা একই। তাকে কথা বললে এক্সট্রা একশ টাকা খরচ হবে।
কেন?
সে মুরগি ছদকা দিবে। একশ টাকার কমে মুরগি মিলে? তার স্বভাব হলো একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছে। সকালে উঠে মুরগি ছদকা। মুরগিতে কাজ হয় বলেন?
ঝড় যেভাবে উঠছে আমার মনে হয়। দুজনের সঙ্গে শেষ কথা বলে নেওয়া ভালো।
রেশমাকে সব জানাব আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মুটকিকে জানানোর কিছু নাই।
ভাবি কি বেশি মোটা?
গ্র্যান্ডের কী জানি সমস্যা। প্রতিদিনই মোটা হচ্ছে। কোনো রিকশা তাকে নিতে রাজি হয় না।
পান ব্যবসায়ী তালেব মুনশি
আপনার টাকাই ছিনতাই হয়েছে?
জি।
এই নিয়ে আপনাকে কখনোই চিন্তিত দেখলাম না।
চিন্তু করে লাভ কী বলেন? আমি ধরে নিয়েছি। টাকাটা ব্যবসায়ে লোকসান হয়েছে।
টাকা ফেরত পাবেন বলে আপনার মনে হচ্ছে না?
কুমির যখন মুরগি গিলে তখন কি মুরগি পাওয়া যায়।
কুমিরের পেট কাটলে পাওয়া যায়। আমার ধারণা আপনি টাকাটা ফেরত পাবেন। লঞ্চ ড়ুবে গেলে টাকাটা কাজে লাগবে না এটাই যা সমস্যা।
তালেব মুনশি বললেন, কারোর না। কারোর কাজে লাগবে। পানি থেকে ডেডবডি তুলবে। মানিব্যাগ টাকার সন্ধানে শরীর হাতাহাতি করবে। শুনেন সাংবাদিক ভাই? লঞ্চভুবি হয়ে বহু লোক মারা গেছে। তাদের ডেডবডি উদ্ধার হয়েছে। কারও কাছে মানিব্যাগ পাওয়া যায় নাই।
ঝড় হঠাৎ করেই প্রবল আকার ধারণ করল। একসঙ্গে চার-পাঁচজন আযানে দাঁড়িয়েছে। মহা বিপদের সময় আযান দিলে নাকি বিপদ কাটে।
আমি আযানের কিছু দৃশ্য ভিডিও করলাম। ফুটেজ হিসাবে তৃষ্ণার কাজে লাগবে। শেষ ইন্টারভ্যু নিতে গেলাম বুড়োমিয়ার।
বুড়ো লাঠি হাতে আগের জায়গাতেই বসে আছে। লঞ্চ দুলছে। লঞ্চের সঙ্গে সঙ্গে সেও দুলছে।
বুড়ো মিয়া
আমি বুড়ো মিয়ার সামনে বসতে বসতে বললাম, এই নিন আপনার চাদর। এখন খুশি?
বুড়ো বলল, চাদর দিয়ে কী করব! লঞ্চ যাবে তলায়ে।
ভয় পাচ্ছেন?
ভয় পাব কোন দুঃখে? অনেকদিন বাঁচলাম। একজীবনে যা দেখার সবই দেখছি। খালি উড়োজাহাজে উঠি নাই।
এই নিয়ে কি আফসোস আছে?
সামান্য আছে।
রাতে তো কিছু খান নাই। ক্ষুধা লাগে নাই?
বেজায় ভুখ লাগছে। ভুখ কঠিন জিনিস। আপনারে বলতে লজ্জা নাই, আমার স্ত্রী মারা গিয়েছিলেন শেষরাতে। দুপুরে এমন ভুখ লাগছে। কাউরে কিছু বলতে পারি না। বাড়িভর্তি আত্মীয়স্বজন। কান্দাকাটি চলছে। শেষে না পাইরা বাজারে এক ভাতের হোটেলে ভাত খাইলাম। আমার মনে হয় আমার জীবনের সবচেয়ে মজার খানা ছিল সেইটা।
আইটেম কী ছিল মনে আছে?
মনে অবশ্যই আছে। শিং, মাছ আলু দিয়া ব্লানছে। ইলিশ মাছের ডিম পটল দিয়ে। কঁঠালের বিচি। আর হিন্দল দিয়ে একটা ভর্তা বানায়েছে, এমন স্বাদের ভর্তা বেহেশতে আছে কি না কে জানে।
বেহেশতের খাওয়া খাদ্য কেমন হবে বলে আপনার ধারণা?
বৃদ্ধ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, মুনশি মাওলানার কাছে শুনেছি। আমরার মতো গরিব মানুষের জন্যে খুব ভালো মনে হয় না।
মুনশি মাওলানার কাছে কী শুনেছেন?
ধরেন। আপনার সামনে দিয়ে সুন্দর একটা পাখি উইড়া যাইতেছে। সেই পাখির মাংস খাইতে ইচ্ছা হইল, তখনই পাখিটা রোস্ট হইয়া মুখের সামনে ঝুলতে থাকবে। আপনি মাংস খায়া হাড্ডি ফেলবেন সঙ্গে সঙ্গে সেই হাড্ডি পাখি হইয়া উইড়া যাবে।
চলুন খেতে যাই।
কই খাব?
খাওয়ার ব্যবস্থা আছে।
বৃদ্ধকে হাত ধরে তুলছি ঠিক তখনি আতর মিয়া উপস্থিত। তার ভাব-ভঙ্গি বিজয়ীর।
আতর বলল, হিমু ভাই ঘটনা শুনেছেন?
না।
রশিদ খানের অ্যাসিসটেন্ট হামজা দশ হাত পানির নিচে।
তুমি ফেলেছ?
নিজে নিজেই পা পিছলায়া পড়ছে।
ক্ষমতা এখন তোমার হাতে?
অবশ্যই। সত্য কথা বলতে কী, ক্ষমতা সবসময় আমার হাতেই ছিল। আর কেউ না বুঝুকি আপনার বুঝার কথা।
আমি হাসলাম। ক্ষমতাধর মানুষের সামনে কারণে অকারণে হাসতে হয়।
আতর বলল, এখন আপনারে শেষ বারের মতো জিগাই, লঞ্চ কি ড়ুবাব? সব খবর আপনি এডভান্স পান। এই খবর পাবেন না তা হবে না।
আমি নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, এই খবর আমি এখনো পাই নাই। তবে ভাব ভঙ্গিতে মনে হয় ড়ুবে যাবে।
কী ভাব ভঙ্গি?
যেসব লঞ্চ, জাহাজ বা বিমানে প্রচুর শিশু থাকে সেগুলি বিচিত্র কোনো কারণে ক্ষতিগ্ৰস্ত হয় না। এই লঞ্চে শিশু নাই বললেই হয়। আমি মাত্র দুজন মাকে দেখেছি তাদের বাচ্চা জড়িয়ে ধরে বসে আছে। মা তাদের জড়িয়ে আছে বলে বাচ্চাগুলি মোটেই ভয় পাচ্ছে না।
আজিব দুনিয়া! ঠিক না হিমু ভাই? অবশ্যই আজিব দুনিয়া।
গণ তওবার সিদ্ধান্ত
গণ তওবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তওবা পড়াচ্ছেন পীর কুতুবি। কুতুবি বললেন, হিন্দু ভাইরাও সামিল হয়ে যান। মহাপ্রলয়ের দিনে হিন্দু-মুসলমান কিছু নাই, সব সমান। মানুষ মানুষে সম্পর্কও শেষ। অমুক আমার স্ত্রী, অমুক বোন এইসবও নাই। সবাই অজু করে আসেন। যাদের কাপড়াচোপড় নিয়া সন্দেহ আছে, তারা মাথায় তিন বালতি পানি ঢেলে আসেন। নাপাকি দূর হবে।