আঠার বছরের সারেং-জীবনে কখনো লঞ্চ ড়ুবি হয় নি?
দুইবার হয়েছে। প্রথম ড়ুবল ছোট একতলা লঞ্চ। নাম এম এম এল মেঘনা!
মানুষ মারা গিয়েছিল?
মানুষ মারা যাবে না? যাত্রী যা উঠেছিল তার অর্ধেক সাফ। একজন ব্রিফকেস ভর্তি টাকা নিয়ে কাপ দিয়েছিল। তার কাছ থেকে ব্রিফকেস নেওয়ার জন্য সাত আটজন ঝাপ দিয়া পড়ল। জীবন বাঁচানোর দিকে নজর নাই ব্রিফকেস নিয়ে হাতাহাতি! সব তলায়া গেল, ব্রিফকেইস ভাইসা রইল। সেই ব্রিফকেইস পাইল আমারই অ্যাসিসটেন্ট কামরুজ্জামান। টাকা কত ছিল বলে নাই। লঞ্চের চাকরি ছেড়ে রাড়-সিমেন্টের দোকান দিয়েছে। গাবতলীতে তিনতলা বাড়ি করেছে। বিয়ে করেছে দুটা।
দ্বিতীয় দফার এক্সিডেন্টের বিষয়ে বলুন।
এইটা ছিল বড় এক্সিডেন্ট। দোতলা লঞ্চ। নাম এম ভি নাইলতাবাড়ি। এম ভি কী বুঝেন?
না।
এম ভি হলো মোটর ভেসিকেল আর এম এল মোটর লঞ্চ। এক্সিডেন্ট হয়েছে ঘন কুয়াশার কারণে। সাহেবরা এই কুয়াশারে বলে ফগ। এক হাত দূরের জিনিসও দেখা যায় না। এর মধ্যে লঞ্চ চলছে। লঞ্চের মালিক সঙ্গে আছেন। বরিশালে তাঁর নাকি জরুরি কাজ, পৌঁছাতেই হবে। তাঁর কারণেই এক ঘণ্টা আগে লঞ্চ ছেড়েছি। আমার বেকায়দা অবস্থা। ঘনঘন বদর বাবার নাম নিতেছি।
বদর বাবাটা কে?
খোয়াজ খিজির। উনার কারবার পানিতে। লঞ্চে এক নতুন জামাই বউ নিয়ে যাচ্ছে। ডেকে তারা আমোদ-ফুর্তির বাজার বসায়েছে। আমি তাদের এক নজর দেখেও এসেছি। বর যেমন সুন্দর তার স্ত্রীও সুন্দর। সচরাচর এরকম দেখা যায় না। বউ সুন্দর হলে জামাই হয় বান্দরের খালাত ভাই।
এক্সিডেন্টের কথা শুনেন। অন্ধকারের মধ্যে আজাদহা এক ট্যাংকার সামনে থেকে দিল ধাক্কা। লঞ্চ দুই ভাগ হয়ে গেল। ড়ুবে গেল দশ থেকে পনের মিনিটের মধ্যে। সর্বমোট তিনশ ছাব্বিশজন মারা গেছে। ছয়-সাত বৎসর আগের কথা। সব পত্রিকায় উঠেছে। পত্রিকা পড়ার অভ্যাস থাকলে নিশ্চয় পড়েছেন।
জামাই বউ কি বেঁচে ছিল?
বউ বেঁচে ছিল। সাঁতার দিয়ে এক চরে উঠেছে। জামাই সাঁতার জানে না। প্ৰাণে বাঁচার জন্য বউকে জাপাটিয়ে ধরেছিল; বউ অতি চালাক মেয়ে, লাথি দিয়ে জামাইকে আগে সরায়েছে। শাড়ি গায়ে সাঁতার দেওয়া যায় না। শাড়ি খুলে সাঁতার শুরু করেছে।
আপনি এত কথা জানলেন কীভাবে? ঐ মেয়ে আর আমি একই চরে উঠেছিলাম। মেয়ের নাম সালমা। তাকে পরে বিবাহ করি।
ইনিই কি সকিনার মা?
জি না; সকিনার মা আমার প্রথম স্ত্রী। আমার তিন স্ত্রী। তিনজনের মধ্যেই আন্তরিক মিল মহব্বত। প্ৰথমজন সংসার দেখে, দ্বিতীয়জন রান্না দেখে। আর সালমা থাকে তার নিজের মতো।
আপনি তো ভাগ্যবান মানুষ। আপনার দুই লঞ্চ পানির নিচে চলে গেল, আপনি টিকে রইলেন।
আমাকে ভাগ্যবান অবশ্যই বলা যায়। যে দুইবার লঞ্চড়ুবি হয়েছে সেই দুইবারই মক্কায় হজ করে এসেছি। আমি ডাবল হাজি।
শুনুন হাজি সাহেব! সবকিছু তিনবার করে ঘটে। এই জন্যেই কথা দানে দানে তিন দান। এই লঞ্চ ড়ুববে, আপনার তিন দান পূর্ণ হবে। হজ করতে যাবেন। আপনি, হবেন ট্রিপল হাজি।
ডাবল হাজি আমার কথা গুরুত্বের সঙ্গে নিলেন বলেই মনে হলো। তিনি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন।
লঞ্চমালিকের কনিষ্ঠপুত্ৰ
কাদের সাহেব
কাদের সাহেবের নেশার ঘোর সামান্য কেটেছে। তিনি বিছানায় আধাশোয়া হয়ে বসা। চোখ সত্যিকার অর্থেই জবাফুলের মতো লাল। ঘরে বমি এবং এলকোহলের মিশ্রণে তৈরি বিষাক্ত গন্ধ।
ভিডিও ক্যামেরা হাতে আমাকে দেখে বললেন, হু ইউ?
বোঝা গেল তাঁর ইংরেজি জ্ঞান সীমাবদ্ধ এবং তিনি সীমাবদ্ধ ইংরেজি জ্ঞানেই কথা বলতে ভালোবাসেন।
আমি বললাম, স্যার আমি পত্রিকার লোক। আপনার একটা মিনি ইন্টারভ্যু নেব।
তিনি হুঙ্কার দিয়ে বললেন, Go Hell.
লঞ্চ ড়ুবে যাচ্ছে এই খবর কি পেয়েছেন স্যার? সাঁতার নিশ্চয়ই জানেন? লুঙ্গি খুলে একটা প্যান্ট বাঁ পায়জামা পরে নিলে ভালো হয়। পানিতে লুঙ্গি খুলে গেলে বেকায়দা অবস্থা হবে। আমার অনুরোধ ড্রেসটা বদলান।
কাদের সাহেব ইংরেজি থেকে বাংলায় ফিরে এলেন। বিড়বিড় করে বললেন, হালারপুতে কয় কী? কথা শেষ করেই আবার বমির প্রস্তুতি নিলেন। বমি ভিডিও করার কিছু নেই। তারপরেও কিছুক্ষণ ভিডিও করলাম। মৃত্যু আতঙ্কে লোকজন বমি করছে—এই ফুটেজ তৃষ্ণা কাজে লাগাতে পারে।
কাদের সাহেব বললেন, এই হালারপুত ছবি তুলবি না। ছবি তুললে ফ্রেস বমি খাওয়ায়ে দিব।
ফ্রেস বা বাসি বমির কোনোটাই খাওয়া ঠিক হবে না ভেবে চলে এলাম।
ছিনতাইকারী
এখনো দড়ি বাঁধা অবস্থায়। চোখে ভরসা হারানো দৃষ্টি।
আমি বললাম, আছেন কেমন? আছি ভালোই কিন্তু আমার খাওন দেয় নাই। খাওয়া নাকি শেষ।
নতুন করে রান্না হবে।
ভাত রানতে পারে। চাউল আছে। হুদা ভাত খাব।
আপনি একাই খাওয়া পান নাই?
হ্যাঁ আমি বাদ পড়েছি।
আপনার সাথে চায়ের দোকানের মালিক বাধা ছিল, সে কোথায়?
জানি না কই। তারে ছেড়ে দিয়েছে, আমি একা আটকা আছি।
ছিনতাইয়ের কাজ কোথায় শিখেছেন?
নিজে নিজে শিখেছি। এর জন্য তো স্কুল-ইউনিভার্সিটি নাই।
ছিনতাই করে সবচেয়ে বেশি উপার্জন কবে করেছেন?
এইবারই করলাম। লাভ কী হয়েছে বলেন? সব নিয়ে গেছে। আনসাররা ভাগ বাটোয়ারা করে নিবে। এখন সাংবাদিক ভাই আপনি বলেন তারা ছিনতাইকারী না? টাকাটা তো তারা আমার কাছ থেকে ছিনতাই করল। ঠিক বলেছি না মিথ্যা বলেছি?