আসুক। আমার কথা শুনলে আপনি কিন্তু ভয়ঙ্কর চমকবেন।
অনেকদিন চমকাই না। আপনার কথা শুনে চমকালে ভালো হবে। বড় ধরনের চমক লিভারের জন্য উপকারী।
তৃষ্ণা মুখ কঠিন করে বলল, আমার ESP. ক্ষমতা বলছে আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে। এই লঞ্চেই বিয়ে হবে। আমি পুরো বিষয়টা স্পষ্ট চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।
কী দেখছেন?
আমি দেখছি লঞ্চ কান্ত হয়ে আছে। একজন বৃদ্ধ আমাদের বিয়ে পড়াচ্ছেন। তার চোখে সুরমা। বৃদ্ধকে দেখামাত্র আমি চিনব। আপনার ঠোঁটের কোণে হাসি। এর অর্থ আপনি এখনো আমার কথা বিশ্বাস করছেন না।
অবশ্যই বিশ্বাস করছি। আমি মানুষকে বিশ্বাস করতে ভালোবাসি।
তৃষ্ণা বলল, আমি আপনাকে চিনি না। আপনার বিষয়ে কিছুই জানি না। তারপরেও আপনাকে বিয়ে করতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কেন জানেন?
না।
কারণ এই বিয়ে পূর্বনির্ধারিত। সবকিছুই যে পূর্বনির্ধারিত আধুনিক বিজ্ঞান এখন এই সত্য হজম করা শুরু করেছে।
আমি জানতাম না। আমি শুনেছি। Free wil।-এর কথা।
এই বিষয়ে আমরা বাসর রাতে তর্ক করব। বাসর হবে। আমার কেবিনে। আমার কাছে বেলিফুলের দুটা মালা আছে। আরও লাগবে। কী অদ্ভুত কো ইনসিডেন্স! সুটকেসে ফুল আঁকা একটা চাদর আছে। এখন চলুন আমরা বুড়োটাকে খুঁজে বের করি।
চলো।
আমরা বুড়োর সন্ধানে প্রথম গেলাম লঞ্চের সারেঙের ঘরে।
এর আগে সারেঙকে দেখেছি বিছানায় শোয়া। এখন দেখলাম বসা অবস্থায়। সারেঙের চোখ রক্তবর্ণ। সারেঙ তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে পরিচিতজনের গলায় বলল, সকিনা! গম আছ নি? চানপুর যার গৈ।
তৃষ্ণা বলল, এই বুড়া না।
আমরা দ্বিতীয় বুড়োর সন্ধানে বের হলাম। এই বুড়ো আমার পরিচিত। তার কাছ থেকে চাদর নিয়েছিলাম। বুড়ো ঠিক আগের জায়গায় বসে আছে। তার দৃষ্টি নিজের হাতের লাঠির দিকে। জাহাজ দুলছে, জাহাজের সঙ্গে বৃদ্ধও দুলছে। মনে হচ্ছে বিশাল রকিং চেয়ারে সে বসা।
বৃদ্ধ আমার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল, বাজান! আমার চাদর কই?
আমি বললাম, চাদর জায়গামতোই আছে।
শীত লাগতেছে। চাদরের প্রয়োজন ছিল।
আমি বললাম, ঝড় ঠিকমতো উঠুক, চাদর এনে রেলিং-এর সঙ্গে আপনাকে বেঁধে দিব। যাতে উড়ে গিয়ে পানিতে না পড়েন।
তৃষ্ণা বলল, আপনি কি ইনাকে চেনেন?
আমি বললাম, চিনি। ঝড়টা ঠিকমতো উঠলে জাহাজের যাত্রী সবাই সবাইকে চিনবে।
তৃষ্ণা বলল, আপনাকে অতি জরুরি কথাটাই জিজ্ঞাস করা হয় নি। আপনি কি ম্যারেড?
না।
দেখুন। আমার অবস্থা। বিয়ের সব ঠিকঠাক করে ফেলেছি, অথচ আপনাকে জিজ্ঞেস করা হয় নি, আপনি ম্যারেড কি না।
আমি বললাম, দুর্যোগের সঙ্গে স্বপ্নের মিল আছে। স্বপ্নে লজিক কাজ করে না। ভয়াবহ দুর্যোগেও লজিক কাজ করে না। দুর্যোগের দৃশ্যগুলিও হয় স্বপ্নের মতো ছাড়াছাড়া।
আপনার বিয়েতে আপত্তি নেই তো?
না।
আমার বয়স কিন্তু বেশি। আটাশ রানিং। বাঙালি ছেলেরা শুনেছি অল্পবয়েসী মেয়ে বিয়ে করতে চায়। বাঙালি ছেলেদের অদ্ভুত মানসিকতা। তারা খুবই কমবয়েসী মেয়ে বিয়ে করতে চায় কিন্তু তাদের হতে হবে উচ্চশিক্ষিত। তাদের রূপ হতে হবে রাজকন্যাদের মতো। তাদের বাবার প্রচুর টাকা পয়সা থাকতে হবে। অথচ ছেলে কিন্তু ভ্যাগাবন্ড। আপনি কি ভ্যাগাবন্ড?
হ্যাঁ।
কী যন্ত্রণা! আমি যে জিনিস পছন্দ করি না। সবই আমার কপালে এসে জুটে।
বিয়েটা কি তাহলে বাতিল?
না। বাতিল কী জন্যে হবে? আপনার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে বাতিল হলে আপনি খুশি হন। পাত্রী হিসেবে আপনি কি আমাকে অপছন্দ করছেন?
না। আমি তব মালঞ্চের হব মালাকার।
কথাটার মানে কী?
আপনার জন্যে ফুলের মালা গাথার কাজটা আমি আগ্রহ নিয়ে করব।
কার কবিতা?
রবীন্দ্রনাথের।
শুনুন, কখনোই আমার সঙ্গে কবিতা কপচাবেন না। কবিতা হচ্ছে অলসের বিলাস। আমি অলস মানুষ পছন্দ করি না।
আচ্ছা।
তৃষ্ণা বলল, এই মুহূর্ত থেকে আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন। আমিও তুমি করে বলব। এতে আপনার কোনো সমস্যা আছে?
না।
হিমু! তোমার মধ্যে আমি গা ছাড়া ভাব দেখছি কেন? ঠিক করে বলো—গ্ৰী হিসেবে তুমি কি আমাকে পছন্দ করছি না? দয়া করে ঝেড়ে কাশ। আমার একটা গুণ শুনলে তুমি চমকে উঠবে। বলব?
বলো।
বেকারি। আমি ভালো পারি। কোর্স নিয়েছি।
বেকারি কী?
কেক পেষ্ট্রি এইসব বানানো। আমি যে ক্টেটে থাকি সেখানে কুকি বানানোর একটা কম্পিটিশন হয়। কুকি হলো বিঙ্কিট। আমি সেই কম্পিটিশনে অনারেবল মেনশন পেয়েছি।
চমৎকার। ধরা যাক কয়েকটা ইঁদুর এবার।
এর মানে কী?
কবিতার লাইন।
বাঙালিদের রোমান্টিসিজম কয়েক লাইন কবিতা আবৃত্তিতে সীমাবদ্ধ। আমার জন্যে খুবই বিরক্তিকর। আগে একবার বলেছি, এখন আরেকবার বলছি, দয়া করে। আমার সামনে কবিতা আবৃত্তি করবে না।
করব না।
শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধ খুঁজে পাওয়া গেল। তৃষ্ণা চেঁচিয়ে বলল, ঐ তো উনি! আমি ইনাকেই স্বপ্নে স্পষ্ট দেখেছি।
তৃষ্ণা দেখাচ্ছে খুনের আসামি পীর কুতুবিকে। আমি বললাম, উনার হাতে হাতকড়া পরানো। স্বপ্নেও কি তাই দেখেছি?
স্বপ্লে হাতকড়া দেখি নি। হাতকড়া কেন?
উনি তিনটা খুন করেছেন। তাঁকে বরিশাল নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ফাঁসি দেওয়ার জন্যে।
ইন্টারেস্টিং ব্যাপার তো। আমি উনার একটা মিনি ইন্টারভ্যু নিতে চাইলে উনি কি রাজি হবেন?
অবশ্যই রাজি হবেন। ইন্টারভুদ্য দেওয়ার জন্যে উনি মুখিয়ে আছেন।
আমাদের বিয়ের কাজি হবেন কি না তা আগে জেনে নেই?