শোভা আপু! আবার হাসতে শুরু করেছেন। এবারে হাসির পাওয়ার আগের বারের চেয়েও বেশি। মনে হচ্ছে চেয়ার থেকে পড়ে একটা দুর্ঘটনাই ঘটবেন। আমি বললাম, আমার খাওয়া শেষ পর্যায়ে। তুমি দুলাভাইকে টেলিফোনে ধরে দাও। তার সঙ্গে কথা বলে তাকে রাগিয়ে দিয়ে আমি বিদায় হব।
এখন চলে যাবি কেন? পান এনে দিচ্ছি। পান খেয়ে ঘুম দে। তোর দুলাভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে তারপর যাবি।
শোভা আপু, দুলাভাইয়ের সঙ্গে আরেক দিন দেখা করব। তবে তোমার সঙ্গে সবসময়ই টেলিফোনে যোগাযোগ থাকবে।
আমার হাতে টেলিফোন। ওপাশে কবীর সাহেব। আমি বললাম, কে দুলাভাই? গুটগুট মুটমুট টেংটেং?
কবীর সাহেব হতভম্ব গলায় বললেন, Who are you?
কে?
শোভা আপুর চিঠিটা কি লিখেছেন? আজি বুধবার, চিঠি দিবস।
গলা শুনে চিনতে পারছেন না? আমি আয়না মজিদ। বলেছিলাম না। দুপুরে বোয়াল মাছের এক টুকরা খেতে চাই। আপনার বাসায় এসে খেয়েছি–রান্না ভালো হয় নি। শোভা আপুর রান্নার হাত জঘন্য। বোয়াল মাছের আঁশটে গন্ধ একেবারেই যায় নি।
কবীর সাহেব আবার বললেন, Who are you?
বললাম না, আয়না মজিদ।
ঘটাং করে শব্দ হলো। তিনি টেলিফোন রেখে দিয়েছেন। তার ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ড চোখের সামনে স্পষ্ট দেখছি। তিনি চাচ্ছেন উড়াল দিয়ে নিজের বাড়িতে চলে আসতে। সেটা সম্ভব না হওয়ায় লাফ দিয়ে জিপে উঠেছেন। ড্রাইভারকে বলছেন, তাড়াতাড়ি চালাও, তাড়াতাড়ি। বারবার ঘড়ি দেখছেন। ঘাম হচ্ছে। ঘামে শার্ট ভিজে উঠেছে। তার হাটের সমস্যা থাকলে টেনশনে ছোটখাটো স্ট্রোকের মতো হয়ে যাবার কথা।
আমি পান মুখে দিয়ে শোভা আপুর কাছ থেকে বিদায় নিলাম। বিদায়ের আগে বললাম, আপু, তুমি এতক্ষণেও আমার নামটা মনে করতে পারলে না। দুঃখ নিয়ে বিদায় নিচ্ছি।
তুই তোর নামের প্রথম অক্ষরটা বল, তাহলেই মনে পড়বে।
নামের প্রথম অক্ষর হি।
হি দিয়ে কোনো নাম শুরু হয়? কেন আমার সন্সে ফাজলামি করছিস? হি দিয়ে কোনো নাম হয় না। হি দিয়ে হয় হিসাব। তোর নাম কি হিসাব?
হ্যাঁ, আমার নাম হিসাব।
তোর নাম হিসাব হলে আমার নাম নিকাশ, আমরা দুই ভাই বোন মিলে হিসাব নিকাশ।
শোভা আপু আমাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। তার চোখ ছলছল করছে। আমি বললাম, You are the sister I never had. নিচু হয়ে শোভা আপুর পা স্পর্শ করলাম। তিনি আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, আল্লাহপাক, আমার এই পাগলা ভাইটাকে সর্ব বিপদ থেকে রক্ষা করো।
কোথায় যাওয়া যায়। তাই ভাবছি। সরীসৃপের মতো গর্তে ঢুকে যেতে হবে। কয়েকদিনের জন্যে out of circulation হয়ে যাওয়া। মাজেদা খালার বাড়ি কিংবা বাদলদের বাড়ি। নিতান্ত অপরিচিত কোনো বাড়ির কলিংবেল টিপে ভাগ্য পরীক্ষা করা যেতে পারে। কলিংবেল টেপা হলো। গম্ভীর চেহারার এক ভদ্রলোক দরজা খুলে বললেন, কী চাই?
আমি বলব, স্যার, দুদিন আপনার বাড়িতে থাকতে পারি? দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী আয়না মজিদ বিষয়ে পড়াশোনা করব। আমার নিরিবিলি দরকার।
বাদলের বাড়িতে যাওয়া ঠিক হবে না। তার পরীক্ষা চলছে। আমার দেখা পেলে তার পড়াশোনা শুধু যে মাথায় উঠবে তা-না, মাথা ফুড়ে বের হয়ে যাবে। তারচে বড় কথা বাদলের বাবা, আমার খালু সাহেব, আমাকে কঠিন এক চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠি না বলে তাকে হাতবোমা বলাই ভালো।
(অতি জরুরি)
বরাবর
হিমু।
বিষয়; বাদলের পরীক্ষা। তোমার কর্তব্য।
হিমু,
তোমাকে কোনোভাবেই খুঁজে না পেয়ে এই চিঠি লিখছি। তোমার মতো ভবঘুরে মানুষকে চিঠি লিখতে রুচি হচ্ছে না। তারপরেও বাধ্য হয়ে লিখছি। কারণ প্রয়োজন বাধ্যবাধকতা মানে না।
বাদলের পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। তুমি নিশ্চয়ই চাও সে পাশ করুক। না-কি চাও না? আমি চাই। তোমার লেজ ধরে ঢাকা শহরে সে হেঁটে বেড়াক এটা আমি চাই না।
বাদলের পরীক্ষা পাশের ব্যাপারে। আমি এখন তোমার সাহায্য চাচ্ছি। তুমি আগামী তিন মাস বাদলের ৫০ হাজার গজের ভেতরে আসবে না। এটা আমার অনুরোধ না, আদেশ। কঠিন আদেশ। আদেশ অমান্য করলে গুলি করে। তোমাকে মেরে ফেলতেও আমি দ্বিধা করব না। তুমি জানো আমার লাইসেন্স করা পিস্তল আছে।…
কিছুক্ষণের জন্যে ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর
কিছুক্ষণের জন্যে ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর হয়ে গেলাম। তিনি স্ট্রিট ল্যাম্পের আলোয় পড়াশোনা করেছেন। আমিও এখন তাই করছি। ল্যাম্পের আলোয় আয়না মজিদের প্রতিবেদন নিয়ে বসেছি। পা ছড়িয়ে বসেছি। পাশেই রাস্তা-পরিবারের কিছু সদস্য। বাবা-মা এবং দুই ছেলে। কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। কম্বল দুটাই নতুন। ঢাকা শহরের কিছু মানুষ আছেন যারা রাস্তাবাসীদের কম্বল দিয়ে ঢেকে দিতে পছন্দ করেন। এরা কম্বল ছাড়া কিছুই দেন না। কেন দেন না সেটা একটা রহস্য।
আমার পাশে শুয়ে থাকা রাস্তা পরিবারের সদস্যদের একজন জেগে গেছে। চোখ বড় করে আমাকে দেখছে। এর বয়স আট নয় বছর। ভাবুক ধরনের চেহারা। নরম বিছানায় টেডি বিয়ার জড়িয়ে শুয়ে থাকলে একে খুব মানাতো। সে আমার দিকে তাকিয়ে কৌতূহলী গলায় বলল, কী করেন?
আমি বললাম, লেখাপড়া করি রে ব্যাটা।
লেখাপড়া করেন ক্যান?
লেখাপড়া না করলে গাড়ি ঘোড়ায় চড়া যাবে না। এই জন্যেই লেখাপড়া। তোর নাম কী?
মজিদ।
বাহ ভালো তো। তুই এক মজিদ আর আমার হাতে আরেক মজিদ।
ছোট্ট মজিদ গভীর কৌতূহলে আমাকে দেখছে, আমিও কৌতূহল নিয়েই পড়ছি আয়না মজিদ বৃত্তান্ত।