দুই ঘণ্টার উপর (আনুমানিক) ঝিম ধরে বসে আছি। আমার অবস্থা হয়েছে ঘড়ির মতো। সময় আটকে গেছে। পঞ্জিকা পড়ে অনেক কিছু জািনছি, তবে এই জ্ঞান কোনো কাজে আসবে এরকম মনে হচ্ছে না। হিন্দু ললনাদের উমাচতুর্থী ব্ৰত পালন করা খুবই প্রয়োজন, এটা জানলাম। এই ব্ৰত পালন করতে হবে জ্যৈষ্ঠমাসের শুক্লা চতুর্থীতে। কারণ এই দিনে সতী উমার জন্ম হয়।
জ্যৈষ্ঠ শুক্ল চতুর্থ্যান্তু জাতা পূৰ্ব্বঝুমা সতী
তস্মাৎসা তপ্ৰ সংপূজ্য স্ত্রীভি : সৌভাগ্যদায়িনী
পঞ্জিকা পড়ে সময় কাটানো ভালো বুদ্ধি বলে মনে হচ্ছে না। বিরক্ত লাগছে। বিরক্তি কাটানোর জন্যেই টেবিলে চেয়ার তুললাম। প্রথমে একটা চেয়ার, তার উপর দ্বিতীয় চেয়ার। কাজটা করতে ভালো লাগছে। নিষিদ্ধ কিছু করার আনন্দ পাচ্ছি। এখান থেকে বের হওয়া সহজ কাজ বলেই মনে হচ্ছে। পুলিশ একটা ভুল করেছে, ঘরে ঢুকিয়ে হাতকড়া খুলে দিয়েছে। কেউ যে এই অবস্থা থেকে পালাবার চিন্তা করতে পারে এটাও তাদের মাথায় নেই। থানার ভেতরে পুলিশরা বেশ রিলাস্কড অবস্থায় থাকে। তারা চিন্তাও করে না। এখানে অপরাধমূলক কোনো কর্মকাণ্ড হতে পারে।
আমেরিকার বিখ্যাত (না-কি কুখ্যাত?) খুনি এডগার ইলেকট্রিক চেয়ারে বসার আগে ক্রিমিন্যাল ভাই বেরাদারদের উদ্দেশে বলে গিয়েছিল— নিখুঁত অপরাধ করতে হয় হালকা মেজাজে। সম্পূর্ণ টেনশনমুক্ত অবস্থায়। একটা দেয়াশলাই জ্বালানোতেও কিছু টেনশন কাজ করে। বারুদ ছিটকে পড়বে কি-না। একবারেই আগুন ধরবে কি-না। অপরাধ করবার সময় সেই টেনশন থাকলেও চলবে না। গুলি কখনো দূর থেকে করবে না। দূর থেকে গুলি করা মানেই টেনশন। গুলি লক্ষ্যভেদ করবে কি করবে না। তার টেনশন। এত ঝামেলার দরকার কী? বন্দুকের নল পেটে লাগিয়ে গুলি করো। একটা টিপস দিচ্ছি–বুকে গুলি করবে না। পাঁজরের হাড় যথেষ্ট শক্ত। রিভসে লেগে গুলি ফিরে এসেছে এমন নজির আছে।
আমি এডগার সাহেবের মতো টেনশনমুক্ত হবার চেষ্টা করলাম। প্রথম চেষ্টাতেই সফলতা। সম্পূর্ণ টেনশনমুক্ত অবস্থায় আমি দরজার পেছনে দাঁড়ানো। অপেক্ষার সামান্য টেনশন ছাড়া তখন আর আমার মধ্যে কোনো টেনশন নেই। আয়না মজিদ সাহেবের তথ্যাবলি সঙ্গে নিয়ে নিয়েছি। বের হতে পারলে বিছানায় শুয়ে আরাম করে পড়া যাবে। মহাপুরুষদের শিক্ষামূলক জীবনী পড়ায় আনন্দ নেই। আনন্দ ক্রিমিন্যালদের রঙিন জীবনীতে। মহাপুরুষরা কখনো ভুল করেছেন এমন পাওয়া যায় না। তাদের সমস্ত কাজকর্মই ডিসটিল ওয়াটারের মতো শুদ্ধ এবং স্বাদহীন।
তালা খোলার শব্দ হচ্ছে। আমি হামাগুড়ি পজিশনে চলে এলাম। তালা খোলার পরপর আমি যদি হামাগুড়ি দিয়ে কবীর সাহেবের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলি– হালুম! এতেও কিন্তু ভদ্রলোক লাফ দিয়ে উঠে ভীত গলায় বলবেন, এটা কী! কোনটা করব বুঝতে পারছি না। পালিয়ে যাবার চেষ্টা, না-কি হালুম গর্জন? সিদ্ধান্তে পৌঁছার আগেই দরজা খুলে গেল। কবীর সাহেব টেবিলের উপর ডাবল চেয়ার দেখে এসব কী? এসব কী? বলে সেদিকে ছুটে গেলেন। আমি হামাগুড়ি দিয়ে দরজার বাইরে চলে এলাম। করিডোরে কেউ নেই। আমি পাঞ্জাবি ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে দাঁড়ালাম এবং অতি অল্প সময়েই পগার পার। (প্রিয় পাঠক! পগারপার জিনিসটা কী? পাগা নামক নদীর পার, না-কি পগার নামক বিশিষ্ট কোনো ব্যক্তির পাড়? তাই বাঁ কেমন করে হয়? ব্যক্তি তো শাড়ি না যে পার থাকবে।)
ক্রিমিনালজিতে বলে একজন ক্রিমিন্যাল অবশ্যই তার ক্রাইমের জায়গাটা দেখতে যাবে। শুধু একবার যে যাবে তা-না, একাধিকবার যাবে। আমার পক্ষে ক্রাইমের জায়গা দেখতে যাওয়া মানে থানায় যাওয়া। এটা সম্ভব না। তবে ওসি সাহেবকে টেলিফোন করা সম্ভব। তার কাছ থেকে একটা ঠিকানা বের করা প্রয়োজন— কবীর সাহেবের বাসার ঠিকানা। কবীর সাহেবের স্ত্রী দশ কেজি ওজনের বোয়াল মাছ রান্না করছেন। বোয়াল মাছের একটা পিস খেতে ইচ্ছা করছে।
ওসি সাহেব টেলিফোন ধরেই ধমক দিলেন, কে? কী চান?
আমি কণ্ঠস্বরে যতটুকু বিনয়ী হওয়া সম্ভব ততটুক বিনয়ী হয়ে বললাম, স্যার আমাকে চিনবেন না। আমি খুলনা থেকে এসেছি। আমার নাম খালেক। খুলনা খালেক বলতে পারেন।
আমার কাছে কী?
খুলনার ওসি সাহেব আপনার জন্যে কিছু জিনিস পাঠিয়েছেন। জিনিসগুলো থানায় নিয়ে আসব?
কী জিনিস?
এক বোতল মধু। জঙ্গলি ফুলের মধু আর সুন্দরবনের তিনটা বনমোরগ।
কী মোরগ?
স্যার তিনটা বনমোরগ। এইসব জিনিস আজকাল পাওয়া যায় না।
ওসি সাহেবের নাম কী?
মিজান।
চিনতে পারছি না তো। ব্যাচামেট মনে হয়। বনমোরগ কয়টা বললে?
স্যার তিনটা।
আমার ধারণা মোরগ পাঠিয়েছে চারটা। তুমি একটা গাপ করেছ। হাঁস মোরগ কেউ একটা তিনটা পাঠায় না। জোড়া হিসাবে পাঠায়।
স্যার, আপনার অসাধারণ বুদ্ধি। বনমোরগ চারটাই পাঠিয়েছিলেন, একটা পথে মারা গেছে।
আবার মিথ্যা! এইসব ধানাইপানাই পুলিশের সঙ্গে কখনো করবে না। বাসার ঠিকানা দিচ্ছি, বনমোরগ চারটা বাসায় তোমার ভাবির কাছে দিয়ে আসবে।
জি আচ্ছা স্যার। এই সঙ্গে কবীর সাহেবের বাসার ঠিকানাটা যদি দেন। উনার জন্যেও এক বোতল মধু পাঠিয়েছেন।
এস বি’র কবীর? ইয়েস স্যার। উনাকে কি একটু টেলিফোনে দেয়া যাবে?
তাকে এখন দেয়া যাবে না। সে আছে বিরাট ঝামেলায়। তার আসামি পলাতক। তার বাসার ঠিকানাও জানি না।