কবীর সাহেব বেল টিপলেন। দুকাপ চা এবং সিংগারা দিতে বললেন। তিনি নিজেই চাবি দিয়ে হ্যান্ডকাফ খুললেন।
বলুন্টু সাইজের যে ছেলেটা ঢুকল সে কিছুক্ষণ ভ্ৰ কুঁচকে এবং ঠোঁট উল্টে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। আমার জন্যে চা আনতে হচ্ছে এটা সে নিতে পারছে না। তার মানসিক সমস্যা হচ্ছে।
কবীর সাহেব হাই তুলতে তুলতে বললেন, আয়না মজিদ, তুমি যে সহজ চিজ না আমরা জানি। আমরাও কিন্তু সহজ চিজ না। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই তুমি মুখ খুলবে। হড়বড় করে কথা বের হতে থাকবে। ঝর্ণাধারার মতো। ঝর্ণাধারা চেনো?
আমি বললাম, চিনি স্যার। ঝর্ণা ঝর্ণা সুন্দরী ঝর্ণা। তরলিত চন্দ্ৰিকা চন্দন বর্ণা। সুন্দরী ঝর্ণা।
স্টপ ইট।
চা চলে এসেছে। দুজনের জন্যে এসেছে। রঙ দেখে মনে হচ্ছে চা ভালো হয়েছে। আমি চায়ে চুমুক দিলাম। চা যথেষ্টই ভালো। প্রথম চুমুক দেবার পরই মনে হয় এই চা পার পর দুকাপ খেতে পারলে ভালো হতো।
আয়না মজিদ।
জি স্যার।
কবীর সাহেব কৌতুহলী হয়ে তাকালেন। আয়না মজিদ ডাকতেই আমি সাড়া দিয়েছি, এটাই তার কৌতুহলের কারণ। তিনি হয়তো ভাবছেন— চিড়িয়া খাচায় ঢুকে গেছে।
তোমার শিষ্যরা কি সব দেশে আছে, না-কি দুএকজনকে ইন্ডিয়া পাচার করেছ?
আমি কাউকে পাচার করি নাই। যারা গেছে নিজের ইচ্ছায় গিয়েছে। ইন্ডিয়া বেড়ানোর জন্যে ভালো।
তোমার বান্ধবী সুষমা কোথায়?
কোথায় আমি জানি না। স্যার। সত্যই জানি না। সুষমা নামে আমার যে বান্ধবী আছে, এটাই জানি না। তবে আপনি যখন বলছেন তখন অবশ্যই বান্ধবী। স্যার, সে কি আমার প্রিয় বান্ধবী?
কবীর সাহেব তার চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মুখ বিকৃত করলেন। মনে হচ্ছে তার চা-টা কুৎসিত হয়েছে। একই ব্লটে বানানো দুকাপ চায়ের একটা এত ভালো হলে আরেকটা জঘন্য হবার কারণ দেখছি না। কবীর সাহেব চায়ের কাপ নামিয়ে শীতল গলায় বললেন, তুমি ধানাইপানাই শুরু করেছ। ডিলা ছাড়া মুখ খুলবে না, বুঝতে পারছি। ডিলা এখন দেব না। সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করব।
দুপুরে লাঞ্চ কি দেয়া হবে?
প্রশ্ন শুনে কবীর সাহেব মনে হলো ধাক্কার মতো খেলেন। ডিলা সন্ধ্যাবেলা শুরু হবার কথা। তার মুখের কঠিন ভঙ্গি দেখে ক্ষীণ সন্দেহ হচ্ছে— ডলার টাইম এগিয়ে আসবে।
কবীর সাহেব দাঁত কিড়ামিড় করে বললেন, লাঞ্চে বিশেষ কোনো ফরমাশ আছে? মোগলাই খানা কিংবা চাইনিজ?
আমি বললাম, যে বোয়াল মাছটা আজ দুপুরে ভাবি রান্না করবেন তার একটা পিস খেতে ইচ্ছা করছে। সাতকড়া দিয়ে মাংস খেয়েছি। বোয়াল খাই নি।
আমার স্পর্ধা দেখে কবীর সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন। কোনো কথা না বলে চায়ে পরপর তিনবার চুমুক দিলেন। প্রতিবারই মুখ বিকৃত করলেন।
বোয়াল মাছের পেটির একটা পিস কি স্যার খাওয়া যাবে?
একটা পিস কেন! আস্ত বোয়ালই খাওয়াবার ব্যবস্থা করছি।
স্যার অশেষ ধন্যবাদ।
ভদ্রলোক উঠে চলে গেলেন। ধড়াস করে শব্দ হলো। বাইরের দরজা লাগানো হলো। এখন রবীন্দ্রসঙ্গীতের সময়। ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে টাইপ সঙ্গীত। অসাধারণ প্ৰতিভার একজন মানুষ–সব পরিস্থিতির জন্যে গান লিখে রেখে গেছেন। ডায়রিয়া হয়ে কেউ বিছানায় পড়ে গেছে। নিজে নিজে ওঠার সামর্থ্য নেই। তার জন্যেও গান আছে— আমার এই দেহখানি তুলে ধর।
দরজায় তালা লাগানো হচ্ছে। তালা লাগানোর অর্থ বেশ কিছু সময় আমাকে এই ঘরে থাকতে হবে। ঘরের দেয়ালে সস্তা ধরনের ঘড়ি আছে। ঘড়িতে নয়টা চল্লিশ বাজে। যখন প্রথম এই ঘরে আমাকে ঢোকানো হয়, তখনো নয়টা চল্লিশ বাজছিল। এই ঘড়ি বেচারার জীবন নয়টা চল্লিশে আটকে গেছে।
টেবিলে লোকনাথ ডাইরেক্টরি পঞ্জিকা দেখতে পাচ্ছি। সময় কাটানোর জন্যে পঞ্জিকা পড়া যেতে পারে। গ্ৰহ-নক্ষত্রের অবস্থান। তিথি বিচার, লগ্ন বিচার। পঞ্জিকার নিচে ভালো রিডিং ম্যাটেরিয়াল পাওয়া গেল। টাইপ করা প্রতিবেদন। শিরোনাম আয়না মজিদ। কবীর সাহেব এই জিনিসই বারবার পড়ছিলেন। লাল কলম দিয়ে দাগ দিচ্ছিলেন। আয়না মজিদ পড়ে তার সম্পর্কে জানা কবীর সাহেবের জন্যে প্রয়োজন ছিল। আমার প্রয়োজন নেই। একটা ফাইল পাওয়া গেল। ফাইলে লেখা ৩৮৯৯, ভেতরে তিন-চারটা সাদা পাতা।
আয়না মজিদ-বিষয়ক লেখাতা ভাঁজ করে হাত নিয়ে নিলাম। কেন জানি মনে হচ্ছে এখানে বেশিক্ষণ থাকা হবে না। বের হব। কীভাবে তাও বুঝতে পারছি না। বাদলের সঙ্গে একবার একটা হলিউডের ছবি দেখেছিলাম। ছবিতে ভয়ঙ্কর এক ক্রিমিন্যালকে ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছে। তাকে কোর্টে নেয়া হবে না। দুজন পুলিশ অফিসার এই ঘরেই তাকে গুলি করে মারবে। ক্রিমিন্যালটা হুডনির মতো বঁধন খুলে ফেলল এবং ঘরের সিলিং ফ্যান ধরে ঝুলতে লাগল। দরজা খুলে দুজন পুলিশ অফিসার ঢুকল। ক্রিমিন্যালটা (নাম হ্যারি) সিলিং ফ্যান ধরে ঝুলতে ঝুলতে ফ্লাইং কিক লাগল। অফিসার দুজন একই সঙ্গে কুপোকাত। হ্যারি বাবু আকাশে একটা ডিগবাজি খেয়ে মেঝেতে ল্যান্ড করলেন। দুই অফিসারের কোমর থেকে দুই পিস্তল নিয়ে নিলেন এবং মিষ্টি করে বললেন, its a beautiful day. গুলি করতে করতে প্ৰস্থান করলেন। বাদল আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বাপকা ব্যাটা!! কী বলেন হিমুদা?
আমি বললাম, বাপক ব্যাটা বললে কম বলা হবে। একই সঙ্গে সে দাদাকা নাতি।
আমার পক্ষে বাপক ব্যাটা কিংবা দাদাক নাতি হওয়া একেবারেই অসম্ভব। তবে হলিউডি ব্যাপারটার একটা বাংলাদেশী রূপ দেয়া যেতে পারে। প্রথমে যা করতে হবে তা হলো টেবিলের উপর একটা চেয়ার তুলতে হবে। আমাকে থাকতে হবে দরজার পেছনে। দরজা খুললে চলে যেতে হবে দরজার পেছনে। কবীর সাহেব দরজা খুলে টেবিলের উপর চেয়ার দেখে হতভম্ব হয়ে এগিয়ে যাবেন সেদিকে। এই ফাঁকে আমাকে শান্তভঙ্গিতে হামাগুড়ি দিয়ে বের হতে হবে। মানুষ এবং বানর শ্রেণী তাকায় Eye level-এ, বাকি সব জন্তু তাকায় মাটির দিকে। এই তথ্য আমি পেয়েছি বাদলের কাছ থেকে। সে পেয়েছে। National Geography চ্যানেল থেকে। বাদলের কাছেই জেনেছি বেচারা শুয়োর জীবনে কখনো আকাশ দেখে না। উপরের দিকে তাকানোর ক্ষমতাই তার নেই। শুয়োরকে এই কারণেই কেউ যদি চিৎ করে ফেলে সে হঠাৎ আকাশ দেখে বিস্ময় এবং ভয়ে অস্থির হয়ে যায়।