বমির ভাব হচ্ছে বলছিলেন।
হলে হবে। তুমি কি মনে কর আমি বমি ভয় পাই?
না, সেরকম মনে করছি না।
দুষ্ট প্রকৃতির মানুষকে আমরা ভয় করতে পারি। বমিকে কেন ভয় করব?
খালু সাহেব বমি শুরু করেছেন। তাকে অসহায় লাগছে। দেখে মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে বমি প্রক্রিয়াটাকে তিনি যথেষ্ট ভয় পাচ্ছেন।
হিমু।
জি।
আজ মনে হয় বমি করতে করতেই মারা যাব। জঘন্য মৃত্যু কী জানো? ডায়রিয়ায় মারা যাওয়া হচ্ছে জগতের জঘন্যতম মৃত্যু। দ্বিতীয় জঘন্যতম মৃত্যু হচ্ছে বমি করতে করতে মারা যাওয়া।
রাত এগারোটা। খালু সাহেবের বাড়ি নীরব। তিনি শান্ত হয়ে ঘুমুচ্ছেন। বাদল horror ছবি নিয়ে তৈরি। ছবির নাম The Eye, আমি টেলিফোন হাতে বারান্দায় হাঁটহীটি করছি। শোভা আপুর সঙ্গে কথা বলছি। নগরীর ওই প্রান্তে কী হচ্ছে জানা দরকার।
শোভা আপু, ঘুমুচ্ছ?
ঘুমাবো কীভাবে? তুই মহা প্যাঁচ লাগিয়ে চলে গেলি। তোর সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করব তাও জানি না। ঠিকানা দিয়ে যাস নি। এদিকে কী হচ্ছে না হচ্ছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
ঘটনা। কী? কোথায় প্যাঁচ লেগেছে খুলে বলো, আমি প্যাঁচ খুলে দিচ্ছি। প্যাঁচ দেয়া কঠিন, খোলা সহজ।
তুই চলে যাবার পরপরই তোর দুলাভাই এসে উপস্থিত। চোখমুখ ফ্যাকাসে, ঘামে গায়ের শার্ট ভেজা। চেনা যায় না। এমন অবস্থা। আমাকে বলল, আয়না মজিদ কোথায়?
আমি বললাম, আয়না মজিদ কোথায় আমি কী জানি? তোর দুলাইভাই তোতলাতে তোতলাতে বলল, দুপুরে বাসায় কে খে। খে খে। খেয়েছে?
আমি বললাম, আমার ভাই খেয়েছে।
সে কোথায়?
সে খাওয়া দাওয়া করে চলে গেছে।
শোভা! তুমি এই পৃথিবীর সবচে বোকা মহিলা।
আমি কোন বোকামিটা করলাম?
তুমি যা কর সবই বোকামি।
এই বলে তোর দুলাভাই যা শুরু করল তারচে বড় বোকামি কিছু হতে পারে না। আয়না মজিদকে খোঁজা শুরু করল। খাটের নিচে খোঁজে। বাথরুমে খোঁজে। ছাদে গেল। সেখানে খুঁজল। ছাদের পানির ট্যাংকের ডালা খুলে সেখানে খুঁজল।
আমি বললাম, পাগলামি করছি কেন?
সে বলল, পাগলামি করছি কেন যদি বুঝতে তাহলে পৃথিবীর সবচে বোকা মহিলা টাইটেল পেতে না।
টাইটেল কে দিয়েছে?
আমি দিয়েছি। এখন আমার সামনে থেকে যাও। আমার সামনে ঘুরঘুর করবে না।
আমি শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে শুয়ে রইলাম। রাতে আরেক কাণ্ড।
কী কাণ্ড?
রাতে পুলিশের তদন্ত টিম এসে উপস্থিত। বলো কী?
তদন্ত করতে এসেছিলেন হামিদ সাহেব। তুই তো উনাকে চিনিস।
আমি কীভাবে চিনব?
উনিই তো বোয়াল মাছ পাঠিয়েছিলেন।
ও আচ্ছা।
উনার কী সব উল্টাপাল্টা প্রশ্ন। প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, ভাবি, আপনার বাসায় কি কেউ বনমোরগ দিয়ে গেছে?
আমি বললাম, না তো!
কেউ কিছু দিয়ে যায় নি? বনমোরগ, মধু, কিছু না?
আমার এক দূরসম্পর্কের ভাই এসেছিল। সে দশ হাঁড়ি টক দৈ নিয়ে এসেছে।
দশ হাঁড়ি টক দৈ? ও মাই গড়! জিনিস ওই টক দৈ-এর ভেতরে।
কী জিনিস?
ভাবি, আমার যতদূর ধারণা ক্যাশ টাকা। পলিথিন দিয়ে টাকা মুড়িয়ে তার উপর টক দৈ দিয়েছে। ওস্তাদ আদমি।
তারপর কী হলো শোন, প্রতিটি টক দৈায়ের হাঁড়ির দৈ বেসিনে ফেলে বিশ্ৰী কাণ্ড।
টাকা পাওয়া গেছে?
পাগলের মতো কথা বলিস কেন? তুই কি দৈ-এর হাঁড়িতে করে টাকা এনেছিস যে টাকা পাওয়া যাবে? ঘটনা এইখানেই শেষ না। হামিদ সাহেব কেচি দিয়ে তোষক বালিশ এইসব কাটা শুরু করলেন। বাড়ি ভর্তি হয়ে গেল তুলায়। আচ্ছা শোন, ঠিক করে বল তো তুই আয়না মজিদ না তো?
না।
বদ আয়না মজিদটাকে দেখতে ইচ্ছা করছে। সে আমার সংসার লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে।
দুলাভাইকে দাও তো, কথা বলি।
ওর সঙ্গে কী কথা বলবি! ওকে তো পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। জিজ্ঞাসাবাদ করবে।
শোভা আপু কাঁদতে শুরু করলেন।
সানগ্লাস চোখে পরেছি
বাদলের কাছ থেকে একটা সানগ্লাস নিয়ে চোখে পরেছি। আমার পৃথিবীর রঙ এখন খানিকটা বেগুনি। কাধে ঝুলছে চটের ব্যাগ। ব্যাগে লেখা— জন্ম নিবন্ধন করুন। জন্ম নিবন্ধনবিষয়ক কোনো সেমিনারে অতি সস্তা। এই ব্যাগ নিশ্চয়ই দেয়া হয়েছে। তারই একটা এখন আমার কাধে। ব্যাগে জন্ম নিবন্ধনের কাগজপত্রের আস্তানার দিকে।
বাদল বলল, হিমুদ, তোমাকে সানগ্রাসে অদ্ভুত লাগছে।
আমি বললাম, আরো অদ্ভুত লাগার জন্যে কী করা যায় বল তো?
মাংকি ক্যাপ পারবে? গরমের মধ্যে মাংকি ক্যাপ অদ্ভুত লাগবে।
দে একটা মাংকি ক্যাপ।
মাংকি ক্যাপ খুঁজে পাওয়া গেল না। তবে একটা উলের লাল টুপি এবং তার সঙ্গে মানানসই কটকটে লাল মাফলার পাওয়া গেল।
বাদল বলল, হাফপ্যান্ট পরবে? তুমি হাফপ্যান্ট পরে হাঁটছ— ভাবতেই কেমন যেন লাগছে।
আমি বললাম, বের কর হাফপ্যান্ট। আজ অদ্ভুত দিবস।
ঢাকা শহরের লোকজনের বিস্মিত হবার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে। বিচিত্র সাজে রাস্তায় নেমেছি, কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না। আমাদের এই শহর চরিত্রের দিক দিয়ে পৃথিবীর বড় শহরদের মতো হয়ে যাচ্ছে। কেউ কাউকে দেখবে না। ব্যস্ত ভঙ্গিতে হাঁটবে। সবার মধ্যে ট্রেন ধরার তাড়া।
কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পারলেও একটা কুকুরের দৃষ্টি আমি আকর্ষণ করলাম। কুকুরটা ঘিয়া কালারের। তার বিশেষত্ব হলো লেজটা কাটা। রবীন্দ্রনাথ এরকম কুকুরকে দেখে লিখেছিলেন—
আত্মীয় কেহ নাই নিকট কি দূর
আছে এক লেজকাটা ভক্ত কুকুর।
লেজকাটা কুকুর মানুষের আশেপাশে থাকতে পছন্দ করে। আমি কুকুরটার নাম দিলাম। টাইগার। নামটা তার পছন্দ হলো। টাইগার বলে ডাকতেই সে মহাউৎসাহে তার কাটা লেজ নাড়াতে লাগল। আমি হাটছি, সে পেছনে পেছনে আসছে। তাকে দুটা এনার্জি বিস্কুট কিনে খাওয়ালাম। বিস্কুটের কারণে সে বডিগার্ড হিসেবে আমার সঙ্গে থাকা মহান দায়িত্ব হিসাবে নিয়ে নিল। ঘেউঘেউ করে কুকুরের ভাষায় সে কিছু কথাবার্তাও বলতে থাকল। কুকুরের ভাষা আমরা এখন বুঝতে পারছি না। বিজ্ঞান একদিন পশুপাখির ভাষা বোঝার যন্ত্র বের করবে। সব মানুষ হয়ে যাবে কিং সুলায়মান। পশুপাখি কীটপতঙ্গের সঙ্গে তার যোগাযোগ স্থাপিত হবে। আমার পেছনে পেছনে যে কুকুরটা আসছে তার সঙ্গে গল্পগুজব করতে করতে আমি এগুব।