রকিবউদ্দিন প্রায় আবারো চোখ বন্ধ করলেন। চোখ বন্ধ করে চাপা গলায় স্কুলজীবনে তাঁর এই চাপা গলাটাই নিচের ক্লাসের ছাত্ররা বেশি ভয় পেত) বললেন, রেস্ট পিরিয়ডে তুমি আমাকে ডেকেছ এই জন্য তুমি আরো পনেরো মিনিট এক্সট্রা পড়বে। শাস্তি।
টগর বলল, জি আচ্ছা, স্যার।
ম্যাথ পড়াব।
জি আচ্ছা।
ম্যাথমেটিকস বানান করো।
M-A-T-H-E-M-A-T-I-C-S।
অ্যারিথমেটিকস বানান করো।
A-R-I-T-H-M-E-T-I-C-S।
হয়েছে। এখন বলো, ম্যাথমেটিকস এবং অ্যারিথমেটিকস—এই দুয়ের মধ্যে প্ৰভেদ কী?
জানি না স্যার।
রকিবউদ্দিন ভূইয়া দুঃখিত গলায় বললেন, বেত মারার শাস্তি উঠে গেছে। শাস্তিটা যদি থাকত। তাহলে ম্যাথমেটিকস এবং অ্যারিথমেটিকসের প্রভেদ না জানার জন্য পাকা চিকন বেতের দুটো বাড়ি খেতে।
বেতের শাস্তি উঠে গেছে কেন, স্যার?
উঠে গেছে। কারণ পৃথিবী থেকে ভালো ভালো জিনিস সবই উঠে যাচ্ছে। আদব-কায়দা উঠে যাচ্ছে। মুরবিদের প্রতি সম্মান উঠে যাচ্ছে। শিক্ষকদের প্রতি ভয় উঠে যাচ্ছে। তার বদলে আসছে—ড্রাগ, গলা পর্যন্ত পানিতে শরীর ড়ুবিয়ে বসে থাকা। তোমার এই ছোট মামার সঙ্গে কথা বলা যাবে?
জি, যাবে।
কষে একটা থাপ্লড় দিতে পারলে ভালো হতো। এক থাপ্পিড়ে খবর হয়ে যেত। সেটা তো আর সম্ভব না। থাপ্পড়ের বদলে দু-একটা শক্ত কথা বলব। থাপ্পড়ের ইংরেজি কী?
স্ল্যাপ।
ম্যাপ বানান বলে।
S-L-A-Pl
হয়েছে। এখন থেকে পাঁচ মিনিট আমি চোখ বন্ধ করে রেস্ট নিব। পাচ মিনিট পর তুমি আমাকে ডাকবে।
জি আচ্ছা, স্যার।
হিমু যে হয়েছে তার নাম কী?
ওনার নাম শুভ্ৰ। গায়ের রঙ ফর্সা তো, এই জন্য তার নাম রাখা হয়েছে শুভ্র।
গায়ের রঙ কালো হলে কী নাম রাখত? কয়লা? যত সব ফাজলামি কথা। যাই হোক যাওয়ার সময় চিজটাকে দেখে যাব।
জি আচ্ছা, স্যার।
আর তোমার বাবাকে বলবে, আজ তোমাদের গাড়িটা আমার একটু বেশি সময়ের জন্য দরকার। বাসায় ফেরার সময় বড় মেয়ের বাসা হয়ে যাব।
জি আচ্ছা।
বড় মেয়েকে দেখতে যাব। এর ইংরেজি কী বলো?
আই উইল ভিজিট মাই এলডেষ্ট ডটার।
মোটামুটি হয়েছে। আমি চোখ বন্ধ করছি, তুমি এই ফাঁকে তোমার বাবার কাছ থেকে পারমিশন নিয়ে রাখো। কোন পারমিশন বুঝতে পারছ তো? তোমাদের গাড়ি কিছুক্ষণ বেশি রাখব সেই পারমিশন।
বুঝতে পারছি, স্যার। পারমিশন বানান করতে হবে?
না, বানান করতে হবে না।
রকিবউদ্দিন ভূইয়া ছাত্রের দিকে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে চোখ বন্ধ করলেন ।
টগরদের বাড়ির চৌবাচ্চাঘর মূলত কাপড় ধোয়া এবং বাসন মাজার কাজে ব্যবহার করা হয়। চৌবাচ্চা ভর্তি করা হয় পানিতে। সারা দিন সেই পানি ব্যবহার করা হয়। আজ দুপুর থেকে বাসন মাজা এবং কাপড় ধোয়া বন্ধ। চৌবাচ্চায় গলা ডুবিয়ে শুভ্র বসে আছে। কাজের মেয়েরা শুরুতে খুব উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল। এখন তারাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। শুভ্র মামা চুপচাপ পানিতে বসে আছে এই দৃশ্য বেশিক্ষণ দেখা যায় না।
হেডমাষ্টার রকিবউদ্দিন ভূইয়া যখন টগরকে নিয়ে চৌবাচ্চাঘরে ঢুকলেন তখন রাত আটটা বাজে। তিনি শুভ্রকে দেখে কিছুক্ষণ। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। শুভ্র বলল, কেমন আছেন, স্যার?
হেডমাস্টার সাহেব বললেন, ভালো। তুমি বয়সে অনেক ছোট, তোমাকে তুমি করে বলি—কোনো অসুবিধা আছে?
কোনো অসুবিধা নেই।
এসএসসি পরীক্ষায় তুমিই তো ফার্স্ট হয়েছিলে?
জি স্যার।
পেপারে ছবি দেখেছিলাম। তখন মনে হয়েছিল চোখে সমস্যা আছে। চোখ তো দেখি ঠিক আছে।
জি স্যার!
কতক্ষণ ধরে পানিতে আছ?
সকাল নটার সময় নেমেছি, এখন বাজছে রাত আটটা—এগারো ঘণ্টা।
শীত লাগছে না।
প্রথম যখন নেমেছিলাম তখন শীত শীত লাগছিল। এখন লাগছে না।
আরাম লাগছে?
আরাম লাগছে না। আবার বেআরামও লাগছে না। সমান সমান অবস্থা।
পানিতে গলা পর্যন্ত ডুবে থেকে লাভ কী?
আপনি যে শুকনায় হাঁটাহঁটি করছেন তাতেই বা লাভ কী?
হেডমাষ্টার সাহেবকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি সামান্য হ’কচাকিয়ে গেছেন। কী বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। শুভ্ৰ বলল, আশপাশের জগৎকে নানাভাবে অনুভব করা যায়। আমি পানির ভেতর বসে জগৎকে অনুভব করার চেষ্টা করছি।
ও!
আদিপ্রাণ সৃষ্টি হয়েছিল পানিতে। সমুদ্রের পানিতে। যে কারণে আমাদের শরীরের পুরোটাই আসলে পানি। রক্তের ঘনত্ব এবং সমুদ্রের পানির ঘনত্বও এক। সমুদ্রের পানিতে যে অনুপাতে সোডিয়াম ক্লোরাইড এবং পটাশিয়াম ক্লোরাইড থাকে, মানুষের রক্তেও ঠিক সেই অনুপাতেই সোডিয়াম ক্লোরাইড এবং পটাশিয়াম ক্লোরাইড আছে। এই কারণেই মানুষ সব সময় পানিতে নামতে চায়।
ও!
পৃথিবীর প্রাচীন অনেক সভ্যতায় পানিতে গলা পর্যন্ত ডুবে থাকার ব্যাপারটা আছে।
ও!
প্রাচীন ইনকা সভ্যতার কথা। আপনি নিশ্চয়ই জানেন। তারা তাদের সম্রাটকে জানত সূর্যের সন্তান হিসেবে। তারা বিশেষ বিশেষ দিনে সূর্যোদয় থেকে সূর্যস্ত পর্যন্ত পানিতে গলা ডুবিয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে মন্ত্রপাঠ করত।
ও!
হিন্দুরা স্নানের সময় গলা পর্যন্ত পানিতে ডুবিয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকে। সূর্যমন্ত্র পাঠ করে।
জি আচ্ছা, স্যার।
আর তোমার বাবাকে বলবে, আজ তোমাদের গাড়িটা আমার একটু বেশি সময়ের জন্য দরকার। বাসায় ফেরার সময় বড় মেয়ের বাসা হয়ে যাব।
জি আচ্ছা।
বড় মেয়েকে দেখতে যাব। এর ইংরেজি কী বলো?