টগর, বলল, কেউ যদি কোনো কারণ ছাড়া গালে ঠাস করে চড় মারে তাহলেও হিমুরা রাগ করে না?
আসল হিমুদের রাগ করা উচিত না।
তাদের কী করা উচিত?
যে চড় দিয়েছে তার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে এমন কিছু বলা উচিত যা শুনলে পিলে চমকে যায়।
সেটা কী রকম?
সেটা কী রকম এখন বলতে পারছি না। এখন মাথায় আসছে না। যাই হোক, তুই এখন আমার সামনে থেকে যা। আমাকে হিমুর ওপর একটা রচনা লিখতে হবে। পয়েন্টগুলো ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে হবে। তুই বাতি নিভিয়ে হাওয়া হয়ে যা।
মশার ওষুধ দেব, ছোট মামা? তোমাকে মশা কামড়াচ্ছে।
কামড়াক। মশা-মাছি প্রকৃতির অংশ। বেঁচে থাকার অধিকার তাদেরও আছে। আমরা যদি হাঁস-মুরগি মেরে রোজ খেতে পারি ওরা কেন আমাদের সামান্য রক্ত খেতে পারে না। মশার কামড়ে হিমুরা বিচলিত হয় না।
টগর আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, বাঘের কামড়ে কি হিমুরা বিচলিত হয়?
শুভ্ৰ জবাব দিল না। চোখ বন্ধ করে ফেলল।
রচনার নাম ‘হিমু’
শুভ্ৰ ভেবেছিল বিশ থেকে পঁচিশ পৃষ্ঠার বিরাট এক রচনা লিখবে। রচনার নাম ‘হিমু’। রচনায় অনেক পয়েন্ট থাকবে। কবিতার উদ্ধৃতি থাকবে। উপসংহার থাকবে। লিখতে গিয়ে দেখল, সব এক পৃষ্ঠায় হয়ে গেছে। অনেক চিন্তা করেও এর বেশি সে কিছু লিখতে পারছে না।
চৌধুরী আজমল হোসেন শুভ্রের হাত থেকে লেখাটা নিলেন। পর পর দুবার পড়লেন। কিছুক্ষণ শুভ্রের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার পড়লেন।
হিমু।
কে, কী ও কেন
হিমু হলো উপন্যাসের একটি চরিত্র।
কী?
সে পকেটবিহীন হলুদ পাঞ্জাবি পরে। খালি পায়ে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটে।
কেন? হিমু সত্যের অনুসন্ধান করে। হলুদ পাঞ্জাবি এবং খালি পা তার বাইরের ব্যাপার। ভেতরে সে সত্য-অনুসন্ধানী।
শুভ্ৰ বলল, আমি যাই?
বড় চাচা বললেন, আচ্ছা যাও। তুমি কি নিশ্চিত হিমু সম্পর্কে যা বলার সব বলা হয়েছে? কিছু বাদ যায়নি?
একটা ব্যাপার শুধু বাদ পড়েছে।
সেটা কী?
হিমুদের কিছু সুপার ন্যাচারাল ক্ষমতা তৈরি হয়। তারা ভবিষ্যৎ বলতে পারে।
তুমি পারো?
না। কারণ আমি পুরোপুরি হিমু হতে পারিনি।
পারছ না কেন?
পারছি না কারণ হিমুর কর্মকাণ্ডগুলো আপনারা করতে দিচ্ছেন না। ছাদে গিয়ে জোছনা দেখতে পারছি না। কলঘরের হাউসে পানি ভর্তি করে সেই পানিতে গলা পর্যন্ত ড়ুবিয়ে বসে থাকলেও কাজ হতো। সেটাও করা যাবে না।
হাউসের পানিতে গলা পর্যন্ত ড়ুবিয়ে বসে থাকলে তুমি ভবিষ্যৎ বলতে পারবে?
পুরোপুরি হিমু হওয়ার দিকে এগোতে পারব। হিমু হয়ে যাবার পর অবশ্যই ভবিষ্যৎ বলতে পারব। ভবিষ্যৎ বলা হিমুদের জন্য কোনো ব্যাপার না।
বড় চাচা কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে থাকলেন। তারপর গলা উচিয়ে বললেন, ঠিক আছে পানিতে গলা ড়ুবিয়ে বসে থাকে। ছাদে গর্ত খুঁড়ে বসে থেকে জোছনা দেখতে পারো। অনুমতি দিলাম। সুপার ন্যাচারেলে ক্ষমতা তৈরি হবার পর আমি তোমার সঙ্গে কথা বলব।
টগরের প্রাইভেট স্যার এসেছেন। স্যারের নাম রকিবউদ্দিন ভূইয়া। স্কুলের হেডমাষ্টার ছিলেন। রিটায়ার করার পর বড়লোকের ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট পড়ান। তাকে গাড়িতে করে নিয়ে আসতে হয় এবং দিয়ে আসতে হয়। ঘড়ি দেখে তিনি এক ঘণ্টা দশ মিনিট পড়ান। দশ মিনিট বাড়তি পড়ানোর কারণ মাঝখানে তিনি দশ মিনিটের জন্য পড়া বন্ধ রাখেন। এই দশ মিনিট তিনি খুব ঠাণ্ডা (বরফ মেশানো) লেবুর শরবত খান। একটা পান খান। পান খাওয়ার সময় চোখ বন্ধ করে চেয়ারে বসে থাকেন। এই সময় কোনোরকম শব্দ করা যাবে না।
রকিবউদ্দিন ভূইয়া অতি কঠিন শিক্ষক। যখন হেডমাষ্টার ছিলেন তখন তার নাম ছিল পিসু-হেড়ু। কারণ তার হুঙ্কার শুনলে ছোট ক্লাসের ছাত্ররা প্যান্টে পিসু করে দিত। হেডমাষ্টার থেকে প্রাইভেট মাস্টার হওয়ার পর তাকে আর কেউ ভয় পায় না। ছাত্রদের ভয় দেখানোর অনেক চেষ্টা তিনি করেছেন (চোখ বড় বড় করে তোকানো, চাপা গলায় হুঙ্কার) কোনোটাতে কিছু
श्8 न्ा।
টগরের স্যার দশ মিনিটের ব্রেক নিয়েছেন। তিনি চেয়ারে হেলান দিয়ে আছেন। তার চোখ ছাত্রের দিকে। তবে তিনি কিছু দেখছেন না। কারণ তার চোখ বন্ধ। শুধু মুখ নড়ছে। কারণ তিনি পান চিবোচ্ছেন। যদিও এই সময় তার সঙ্গে কোনোরকম কথাবার্তা বলা সম্পূর্ণ নিষেধ। তারপরও টগর কথা বলল, স্যার, আজকে কিন্তু আমাকে আগে আগে ছেড়ে দিতে হবে।
রকিবউদ্দিন চোখ মেললেন। চোখের দৃষ্টি ভয়ঙ্কর করার চেষ্টা করতে করতে বললেন, টগর, তোমাকে না বলেছি আমার রেস্ট পিরিয়ডে কোনো কথা বলবে না?
ভুলে গেছি, স্যার।
কেন তুলে গেছ?
স্যার, আজকে আমার মাথায় খুব টেনশন। আমার ছোট মামা হিমু হয়ে গেছেন। পানির হাউসে গলা পর্যন্ত ড়ুবিয়ে বসে আছেন। এই জন্য আমার খুব টেনশন হচ্ছে। সব কিছু ভুলে যাচ্ছি।
টেনশন বানান করো।
T-E-N-S-I-O-N।
হয়েছে। এখন বলো তোমার ছোট মামা কী হয়েছেন?
হিমু হয়েছেন। পানিতে গলা পর্যন্ত ড়ুবিয়ে বসে আছেন।
মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
জি না। হিমু হয়েছেন। হিমু হলে এইসব করতে হয়। গলা পর্যন্ত পানিতে ড়ুবিয়ে বসে থাকতে হয়। মাটিতে গর্ত করে গর্তে বসে জোছনা দেখতে হয়।
পাকা বেত দিয়ে দশটা বাড়ি দিলে ঠিক হয়ে যেত। দেশ থেকে বেত উঠে গেছে তো, এই জন্যই এত সমস্যা দেখা দিয়েছে। ইংরেজিতে একটা বাগধারা আছে, স্পেয়ার দি ব্রড, স্পয়েল দি কিড়। গলা পর্যন্ত পানিতে ড়ুবে বসে আছে! ফাজিল!