টগরের বাবা বললেন, ভাইজান, বাদ দিন তো। হিমু হওয়া মনে হচ্ছে বাচ্চাদের একটা খেলা।
বড় চাচা বললেন, বাচ্চাদের খেলা বলে উড়িয়ে দেয়া ঠিক হবে না। তুমি বোধ হয় জানো না হিমু কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে এই বাড়ির ছাদে কয়েক টন মাটি তোলা হয়েছে।
কী বলছেন, ভাইজান?
বড় চাচা শুভ্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, শুভ্ৰ! কী পরিমাণ মাটি তোলা হয়েছে তুমি একটা আন্দাজ দিতে পারবে?
শুভ্র বলল, প্রতিদিন দুশ টাকা করে আমি দুজন লেবার রেখেছি। এরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছাদে মাটি তুলেছে। কতটুকু মাটি হয়েছে আমি জানি না।
মাটি কেন তোলা হয়েছে?
জোছনা দেখার জন্য।
বুঝতে পারলাম না। একটু বুঝিয়ে বলো।
শুভ্র বলল, হিমুদের জোছনা দেখতে হয়। সাধারণ মানুষের জোছনা দেখা আর হিমুদের জোছনা দেখা এক না। তারা বিশেষভাবে জোছনা দেখে। যেমন পুকুরে গলা পর্যন্ত ড়ুবিয়ে শুধু মাথা বের করে জোছনা দেখে। কিংবা মাটিতে গর্ত করে সেই গর্তে মাথা পর্যন্ত ড়ুবিয়ে জোছনা দেখে।
ছাদে মাটি নেয়া হচ্ছে গর্ত বানিয়ে জোছনা দেখার জন্য?
জি।
হলুদ পাঞ্জাবির ব্যাপারটা কী?
হলুদ হলো বৈরাগ্যের রঙ। আগুনের রঙ। আগুন যেমন খাদ পুড়িয়ে সোনাকে শুদ্ধ করে, এই পোশাকও তাই করে।
বড় চাচা হাত তুলে শুভ্রকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তোমার যুক্তিতে ভুল আছে। আগুন শুধু খাদ পোড়ায় না। আগুন সব কিছুই পোড়ায়। আর তুমি বলছি হলুদ বৈরাগ্যের রঙ, আগুনের রঙ। আমি যদি বলি হলুদ বিষ্ঠার রঙ, তাহলে কি ভুল হবে? বিষ্ঠা কী তা নিশ্চয়ই জানো। বিষ্ঠা হলো গু। প্লেইন অ্যান্ড সিম্পল গু। যার ইংরেজি নাম শিট।
টগরের খুবই হাসি পাচ্ছে। সে চেষ্টা করছে না হেসে থাকতে। বড়দের কথার মাঝখানে ছোটরা হেসে ফেললে বড়রা খুবই রাগ করে।
বড় চাচা বললেন, শুভ্ৰ, শোনো, তোমাকে আমি বুদ্ধিমান ছেলে হিসেবে জানতাম। স্মার্ট ছেলে হিসেবে জানতাম। তোমার বুদ্ধিশুদ্ধি যে বুড়িগঙ্গার পানিতে ধুয়ে-মুছে চলে গেছে তা জানতাম না। তুমি নির্বোধের মতো আচরণ করছি।
শুভ্র বলল, হলুদ পাঞ্জাবি পরছি এই জন্যই কি আমি নির্বোধ?
খালি পায়ে হাঁটছ এই জন্য নির্বোধ। ময়লা-আবর্জনাভর্তি রাস্তাঘাট। এর মধ্যে খালি পায়ে হাঁটার অর্থ হলো, ইচ্ছা করে শরীরে ময়লা মাখা। বুঝতে পারছ কী বলছি?
শুভ্ৰ চুপ করে রইল। হঁহা-সূচক মাথা নাড়ল না। অর্থাৎ সে যে বোকামি করছে এটা বুঝতে পারছে না। বড় চাচা বললেন, হিমু ঘটনাটা কী আমি তা কিছুই বুঝতে পারছি না। যাই হোক শুভ্ৰ, তুমি যেটা করবে, হিমুর ঘটনাটা কী, তুমি কেন হিমু হতে চাচ্ছি—তা সুন্দর করে লিখে ফেলবে। আমি লেখাটা পড়ব। পড়ার পর তোমার সঙ্গে আরেকটা মিটিং হবে।
টগরের বাবা বললেন, ছাদে যে মাটি তোলা হয়েছে সেই মাটির কী হবে? বড় চাচা বললেন, মাটি অবশ্যই নামিয়ে ফেলা হবে। তবে এই মুহূর্তে না। হিমুর ব্যাপারটা আমি আগে জেনে নেই। তারপর।
শুভ্ৰ বলল, আমি কি এখন যেতে পারি?
বড় চাচা বললেন, হ্যাঁ, যেতে পারো।
সুলতানা বললেন, আমি মুরগির মিষ্টি কাবাব বানিয়েছিলাম। কাশ্মিরের রেসিপি। কাশ্মিরের হাউসবোটে এই কাবাব আমি খেয়েছিলাম। এখনো তার স্বাদ মুখে লেগে আছে। ওদের কাছ থেকে রেসিপি নিয়ে এসেছি। কাবাব সার্ভ করে দেই? শুভ্ৰ! কাবাব খেয়ে তারপর যেখানে ইচ্ছা যা।
শুভ্ৰ সুলতানার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল, আপা, তোমাকে আমি খুবই পছন্দ করি। তুমি মনে কষ্ট পাও এমন কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু হিমুরা সত্যি কথা বলে। তাতে যদি কেউ মনে কষ্টও পায় তারপরও বলে। ব্যক্তিগত সম্পর্ক হিমুদের কাছে কোনো ব্যাপার না। আপা শোনো, তুমি যে পরীক্ষামূলক খাবারগুলো বানাও তার সবই অখাদ্য। কেউ খায় না। খাবারগুলো ফ্রিজে থাকে তারপর ফেলে দেয়া হয়। একটা দরিদ্র দেশের খাবার তুমি এইভাবে নষ্ট করতে পারো না। তোমার মািনরক্ষার জন্য তোমার এই অখাদ্য মিষ্টি মুরগির কাবাব অনেকেই মুখে দেবে। আমারও একটুকরা মুখে দেয়া উচিত। কিন্তু হিমুরা কারো মানরক্ষার জন্য কিছু করে না। আমি একটা টুকরাও মুখে দেব না।
টগর সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমিও না। এবং বাবাও খাবে না।
টগরের বাবা ছেলের কথায় সায় দিয়ে দ্রুত মাথা নাড়লেন।
বড় চাচা ছোট্ট একটা পিস মুখে দিয়ে বললেন, খেতে খারাপ হয়নি তো! ভালোই হয়েছে। তবে মিষ্টি বেশি হয়েছে, আমার আবার ডায়াবেটিসের ভাব আছে। মিষ্টি খাওয়া ঠিক হবে না। এই বলে যে ছোট্ট পিসটা মুখে নিয়েছিলেন সেটা সিঙ্কে ফেলে দুবার কুলি করে ফেললেন।
টগরের বাবার সামনে যখন কাবাবের প্লেট ধরা হল তখন তিনি সুলতানার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই বস্তু তুমি নিজে খেয়েছ?
সুলতানা বললেন, না।
তুমি খাওনি কেন?
যে রান্না করে সে খেতে পারে না।
চএর পর থেকে যে বস্তু তুমি রান্না করবে তা আগে নিজে আধা প্লেট খাবে তারপর সার্ভ করবে।
ছোট মামা ঠিক আগের জায়গায় ফিরে গেছেন। ঝিম ধরে বসে আছেন। তাকে দেখেই মনে হচ্ছে তিনি রেগে আছেন। টগর খুব ভালো করে জানে রেগে যাওয়া মানুষের আশপাশে থাকা ঠিক না। তারপরও সে ছোট মামার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। গলার স্বর যথাসম্ভব করুণ করে বলল, ছোট মামা, তুমি কি রাগ করেছ?
না।
তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি রেগে আছে।
তুই ঠিক ধরেছিস। মনের ভেতর থেকে রাগটা সরিয়ে দিয়েছি। শরীর থেকে সরাতে পারিনি। পুরোপুরি হিমু এখনো হতে পারিনি। পুরোপুরি যারা হিমু। হয় তারা কোনো কিছুতেই রাগ করে না।