পাপ নং ২১৩
আড়াল থেকে বড় চাচার কথা শুনেছি।
এর পাশেই সে লিখল :
পুণ্য নং ২১৩
আড়াল থেকে বড় চাচার কথা শোনার পর পাপ কাটান দেয়ার জন্য এই পুণ্যটা করা হবে। এখনো করা হয়নি। তবে আজই করা হবে। বড় চাচার ঘর থেকে যে ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা নেয়া হয়েছে সেটা কোনো এক ফাঁকে বড় চাচার ড্রয়ারে রেখে দেয়া হবে। তিনি হারানো ম্যাগনিফাইং গ্লাস পেয়ে আনন্দ পাবেন। এতে পুণ্য হবে। মানুষকে আনন্দ দেয়াতেই পুণ্য।
টগর পাপ-পুণ্যের খাতা থিফ বক্সে রেখে সাবধানে তার গোপন জায়গা থেকে বের হয়ে এল। সে ভেবেছিল তার জন্য বাড়িতে খোঁজাখুঁজি পড়বে। দেখা গেল সে রকম কিছু না। কেউ তাকে খুঁজছে না। সে নীলুর ঘরে গেল। নীলু আনন্দিত গলায় বলল, এই টগর, আমি অঙ্ক বইটা পেয়েছি।
টগর, বলল, কোথায় পেয়েছিস?
যেখানে হারিয়েছিলাম। সেখানেই পেয়েছি। আমার কী ধারণা জানিস? আমার ধারণা কোনো ভূতের কাণ্ড। এই বাড়িতে ভূত আছে। কাজের বুয়ারও তাই ধারণা। সে নাকি ভূত দেখেছে। আমি ঠিক করেছি একদিন প্লানচেট করে ভূত আনব।
কবে?
আমার পরীক্ষার পরে। ক্লাসের বন্ধুদের বলব। রাতে সবাই আমার সঙ্গে থাকবে। রাত বারোটার পর ভূত নামানো হবে। তুই থাকবি?
আমি ভূত-ফুত বিশ্বাস করি না।
ভূত যখন তোর কান মলে দেবে তখন বিশ্বাস করবি।
টগর বলল, আজ যে ছোট মামার বিচার হবে তুই জানিস?
নীলু বলল, জানি।
বিচার দেখবি না?
আমার বিচার দেখার শখ নেই। তা ছাড়া ছোটরা বিচারে থাকতেও পারবে না। বিচার-ফিচার আমার ভালোও লাগে না। আমি যে বইটা ফেরত পেয়েছি এতেই আমি খুশি।
নীলুকে খুবই আনন্দিত মনে হচ্ছে। নীলুর আনন্দ দেখে টেগরের ভালো লাগছে। নীলু যত আনন্দিত হবে টেগরের পুণ্য হবে তত বেশি। আজ মনে হয়। পাপের চেয়ে পুণ্য বেশি হয়েছে।
সন্ধ্যার পর বিচারসভা বসার কথা।
বিচারসভা বসতে বসতে আটটা বেজে গেল। খুবই আশ্চর্যজনক ঘটনা, টগরকে ডাকা হয়েছে বিচারসভায়। তার মতো ছোট মানুষকে বিচারসভায় কেন ডাকা হয়েছে কে জানে? টগর বসেছে বড় চাচার খাটে। ছোট মামাও একই খাটে বসেছেন। তবে অনেকখানি দূরে। তিনি এমনভাবে বসেছেন যে টগর তার মুখ দেখতে পাচ্ছে না।
বড় চাচা আধশোয়া হয়ে তার বড় ইজিচেয়ারে বসেছেন। তার মাথার নিচে বালিশ। পায়ের ওপর পাতলা চাদর। আরাম আরাম ভাব।
টগরের বাবা-মা বসেছেন। পাশাপাশি বেতের চেয়ারে। চেয়ার দুটো বড় চাচার ঘরে থাকে না। বিচারসভা যখন বসে তখন আনা হয়। টগরের বাবার মনে হয় কোনো কাজ আছে। তিনি কিছুক্ষণ পর পর হাতের ঘড়ি দেখছেন। টগরের মা সুলতানা হাই তুলছেন। সুলতানা শুধু রান্নাবান্নার সময় হাই তোলেন না। অন্য যেকোনো সময় হাই তোলেন। সুলতানার চিন্তা-ভাবনা বিচারসভাতে নেই। তাঁর মন পড়ে আছে। মুরগির মিষ্টি কাবাবে। মিষ্টি কাবাব বানানো হয়েছে। তিনি ঠিক করে রেখেছেন বিচারসভা শেষ হওয়ার পর সবাইকে সেই কাবাব খেতে দেয়া হবে। বিচারসভার শেষে কাবাব খাওয়ার মতো পরিস্থিতি থাকবে কি না এটা নিয়েই তিনি চিন্তিত।
টগরের বাবা বললেন, ভাইজান, বড়দের মধ্যে টগর কেন? ওকে যেতে বলি?
বড় চাচা বললেন, না। ওকে আমার প্রয়োজন।
এই বলেই তিনি চোখ বন্ধ করালেন। বাইরের কেউ উপস্থিত থাকলে মনে করত। উনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। তাকে যারা ভালোমতো চেনে তারা জানে যে এটা তার একটা স্টাইল। জটিল কোনো কথা বলার আগে ঘুম ঘুম ভাব করবেন। হালকা নাকডাকা টাইপ শব্দও করবেন। সবাইকে পুরোপুরি বিভ্রান্ত করে হঠাৎ ইজিচেয়ারে উঠে বসবেন।
টগর, সেই বিশেষ সময়ের অপেক্ষা করছে। তার ইচ্ছা করছে ছোট মামার মুখের ভাবটা দেখতে, সেটা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ তার মুখ দেখা যাচ্ছে না এবং তিনি একবারও টগরের দিকে তাকাচ্ছেন না। টগর যেটা করতে পারে তা হচ্ছে সে যেখানে বসে আছে সেখান থেকে উঠে এসে ছোট মামার পাশে বসতে পারে। কাজটা করা ঠিক হবে কি না সে বুঝতে পারছে না। বড় চাচা তাতে বিরক্ত হতে পারেন এবং বিরক্ত হয়ে বলতে পারেন, তোমার এখানে থাকার দরকার নেই। তুমি যাও, পড়াশোনা করো। টগর মনে-প্ৰাণে বিচারসভায় থাকতে চাচ্ছে।
ইজিচেয়ারে বড় চাচা হঠাৎ নড়ে উঠলেন। চোখ মেললেন। সবার দিকে একবার করে তাকিয়ে দৃষ্টি স্থির করলেন টগরের মুখের ওপর।
গম্ভীর গলায় বললেন, টগর আছিস?
টগর, বলল, জি বড় চাচা।
তুই তোর ছোট মামা সম্পর্কে আমাকে গোপনে কী বলেছিস তা আবার বল, সবাই যেন শুনতে পায়।
টগর, হকচকিয়ে গেল। ছোট মামার হিমু হওয়ার সব খবর সে বড় চাচার কাছে সাপ্লাই করেছে। বড় চাচা যে এরকম মিটিং করে তার কথা ফাঁস করে দেবেন তা সে ভাবেনি। সবাই তাকাল তার দিকে। ছোট মামাও তাকালেন। তার চোখে বিস্ময়।
বড় চাচা বললেন, চুপ করে আছিস কেন, বল।
টগর বিড়বিড় করে বলল, ছোট মামা হিমু হয়ে গেছে।
কী হয়ে গেছে?
হিমু।
টগর লক্ষ করুল সবাই ছোট মামার দিকে তাকাচ্ছে। শুধু ছোট মামা তাকিয়ে আছে তার দিকে। বড় চাচা বললেন, হিমু হয়ে যাওয়া ব্যাপারটা বল শুনি।
টগর, বলল, আমি বলব?
বড় চাচা বললেন, প্রথমে তুমি বলবে। তারপর হিমু সাহেবের মুখ থেকে শুনব। ইংরেজিতে একে বলে, লিসেনিং ফ্রম দি হর্সেস মাউথ।
টগর বলল, হিমুদের হলুদ পাঞ্জাবি পরতে হয়। আর খালি পায়ে হাঁটাহাঁটি করতে হয়।
বড় চাচা বললেন, কেন?
টগর, বলল, কেন সেটা হিমুরা জানে। আমি তো হিমু না। আমি জানি না।