রাগ করবেন কেন?
রাগ করবেন। কারণ অসুখ থেকে ওঠার পর থেকে বড়দের কারোর মুখ দেখতে দাদিয়ার ইচ্ছা করছে না। শুধু ছোটদের মুখ দেখতে ইচ্ছা করছে। বড়দের মুখ দেখলেই রাগ লাগছে।
দাঁড়া, চা নিয়ে যা।
টগর জানে তার নামে দুটো পাপ লেখা হয়ে গেছে। মিথ্যা কথা বললে এমনিতেই পাপ হয়। সেই মিথ্যা মায়ের সঙ্গে বললে পাপ ডাবল হয়ে যায়। তবে এই পাপ কাটানোর বুদ্ধি টগরের আছে। এখন কোনো একটা ভালো কাজ করতে হবে। পাপ এবং পুণ্যতে যেন কাটাকাটি হয়ে যায়।
ভালো কাজ কী করবে তা সে ঠিক করে ফেলেছে। তার বড় বোন নীলুর টেবিল থেকে তার অঙ্ক বইটা চুরি করে কোথাও লুকিয়ে রাখবে। আগামীকাল নীলুর অঙ্ক পরীক্ষা। বই খুঁজে না পেয়ে সে অস্থির হয়ে পড়বে। একসময় কান্নাকাটি শুরু করবে। তখন সে বইটা বের করে নীলুকে দেবে। এটা একটা ভালো কাজ। এই ভালো কাজে আর আগের মন্দ কাজে কাটাকাটি হয়ে যাবে। মাইনাস ওয়ান প্লাস ওয়ান সমান সমান জিরো।
শুভ্ৰ চায়ে চুমুক দিয়ে আনন্দিত গলায় বলল, টগর, চা-টা ভালো হয়েছে।
বাসার চা কখনো ভালো হয় না। আশ্চর্যজনকভাবে এটা হয়েছে।
থ্যাঙ্কস! টগর বলল, ছোট মামা, তোমাকে আজ কী শাস্তি দেবে তুমি জানো?
না।
আমার মনে হয় বাড়ি থেকে বের করে দেবে।
তা দেবে না। তবে আমি নিজেই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাব।
কেন?
হিমুরা এক বাড়িতে বেশি দিন থাকতে পারে না। তাদের পথে পথে বেশি ঘুরতে হয়। জোছনা হলে বনে-জঙ্গলে গিয়ে জোছনা দেখতে হয়। বৃষ্টি হলে বৃষ্টিতে ভিজতে হয়।
তাতে কী লাভ?
গাধার মতো কথা বলিস না তো টগর। মানুষ হয়ে জন্মেছিস মানুষের মতো কথা বলবি। হিমুরা কি লাভ-লোকসান হিসাব করে চলে? তারা কি বিজনেসম্যান? ব্রিফকেস হাতে নিয়ে ঘুরবে। কারো সঙ্গে দেখা হলেই হাতে একটা কার্ড ধরিয়ে দিয়ে তেলতোলে মুখে হাসবে। যা আরেক কাপ চা নিয়ে আয়। এবারেরটাও যেন আগের মতো হয়।
আর চা না খেলে হয় না? বেশি চা খাওয়া তো ভালো না।
তোকে জ্ঞানীর মতো কথা বলতে হবে না। তোকে চা নিয়ে আসতে বলেছি নিয়ে আয়। চা খেতে খেতে একটা রহস্য উদ্ধারের চেষ্টা করব।
কী রহস্য?
আমি যে হিমু হয়ে গেছি, এটা তোর বড় চাচা কীভাবে জানল?
টগর বলল, এই বাড়িতে ওনার অনেক স্পাই আছে। বাড়ি গিজগিজ করছে স্পাইয়ে।
শুভ্র বলল, তাই তো দেখছি। তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা চা নিয়ে আয়।
টগর অনাগ্রহের সঙ্গে রান্নাঘরের দিকে রওয়ানা হলো। তার কেন জানি মনে হচ্ছে দ্বিতীয়বার চা চাইতে গেলেই সব ধরা পড়ে যাবে। টগরের বুক টিপটিপ করছে। এর মধ্যে নীলু আবার অতিরিক্ত রকমের হৈচৈ শুরু করেছে, আমার অঙ্ক বই, আমার অঙ্ক বই। বাড়ি মাথায় তোলার মতো চিৎকার। টগরের খুবই বিরক্তি লাগছে। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলেই কি বই পাওয়া যাবে! যখন সময় হবে বই আপনা-আপনি চলে আসবে।
নীলুর চিৎকার শুনে বড় চাচা বের হয়ে এসেছেন। তিনি নীলুকে তার ঘরে ডেকে পাঠিয়েছেন। লক্ষণ ভালো মনে হচ্ছে না। বড় চাচার যে বুদ্ধি তিনি নীলুর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বললে বুঝে ফেলতে পারেন, অঙ্ক বই পাওয়া যাচ্ছে না। কেন। কাজেই এখন যেটা করতে হবে তা হলো, অঙ্ক বইটা এনে আগের জায়গায় রেখে দিতে হবে। বেশি দেরি করা যাবে না। টগর তা-ই করল। যেখানকার বই সেখানে।
টগর অঙ্ক বই নীলুর পড়ার টেবিলে রেখে বড় চাচার ঘরের দিকে রওয়ানা হলো। তার উদ্দেশ্য বড় চাচার সঙ্গে নীলুর কথাবার্তা যদি কিছু শোনা যায়। আড়াল থেকে অন্যের কথা শোনা খুবই অন্যায়। বিরাট পাপ হয়। এই কাজটা টগরের করতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে। আড়াল থেকে কথা শোনার পাপ কাটান দেয়ার জন্য ছোটখাটো কোনো পুণ্য করতে হবে। পাপ করলেই পুণ্য করে সব সমান সমান রাখা। সে বড় চাচার ঘরের দরজার ওপাশে দাঁড়াল।
নীলু ফোঁপাচ্ছে। ফোঁপানোর শব্দ শোনা যাচ্ছে। বড় চাচা বললেন, ফোঁপানি বন্ধ করা নীলু। বই পাওয়া যাচ্ছে না, এটা এমন কোনো বড় ব্যাপার না যে তার জন্য ফুঁপিয়ে কাঁদতে হবে। রাজ্য ছেড়ে রাজা বনবাসী হলেও কোনো রানী এভাবে কাঁদে না।
নীলু ফোঁপানি বন্ধ করল।
কী বই পাওয়া যাচ্ছে না?
অঙ্ক বই। আমি অঙ্ক করছিলাম। মাঝখানে দশ মিনিটের জন্য বাথরুমে হাত-মুখ ধুতে গিয়েছি। ফিরে এসে দেখি বই নেই।
বই হাওয়া হয়ে গেছে?
হুঁ।
তোমার কি কাউকে সন্দেহ হয়?
না।
বই খুঁজে না পাওয়ার ঘটনা তো তোমার ক্ষেত্রে আগেও ঘটেছে। কিছুদিন পর পরই তো শুনি তোমার এই বই পাওয়া যাচ্ছে না, ওই বই পাওয়া যাচ্ছে না।
জি।
অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর যখন সবাই হাল ছেড়ে দেয়। তখন আবার বই খুঁজে পাওয়া যায়।
জি।
রহস্যটা কী?
জানি না বড় চাচা।
তোমার পড়ার ঘরে যাও, দেখো বই আবার ফিরে এসেছে কি না।
জি আচ্ছা।
যদি বই ফিরে না আসে তাহলে ড্রাইভারকে নিউমার্কেটে পাঠাও, সে বই কিনে আনবে। বইয়ের শোকে মরাকান্না কাঁদতে হবে না। বই মারা যায়নি। বই জীবিত আছে।
জি আচ্ছা।
আমার ধারণা, বই নিয়ে এই রসিকতা কে করছে তা আমি বুঝতে পারছি। তুমি টগরকে একটু আমার কাছে পাঠাও।
বড় চাচার কথা শুনে টগরের বুক ধক করে উঠল। কী সর্বনাশ, কাজটা যে সে করেছে এটা কি বড় চাচা ধরে ফেলেছেন? টগর অতি দ্রুত তার গোপন জায়গায় চলে গেল। এই মুহূর্তে বড় চাচার সামনে পড়ার কোনো মানে হয় না।
এ বাড়িতে টগরের একটা গোপন জায়গা আছে। গোপন জায়গার খবর এ বাড়ির কেউই জানে না। টগরের ধারণা, কেউ কোনোদিন জানতেও পারবে না।